May 18, 2024

ফরচুন নিউজ ২৪

বিদেশি ব্র্যান্ডের দখলে ঈদবাজার, কোণঠাসা দেশীয় জুতা

1 min read

বাঙালির ঈদ আনন্দের অন্যতম অনুষঙ্গ নতুন জামা-জুতা। পাঞ্জাবি-শাড়ির সঙ্গে একাজোড়া নতুন জুতা ছাড়া যেন অসম্পূর্ণ থেকে যায় সাজ। রমজান এলেই তাই জুতা-স্যান্ডেলের চাহিদা বাড়ে কয়েকগুণ। ক্রেতাদের এই বাড়তি চাহিদা মেটাতে চট্টগ্রামের দেশীয় জুতা কারখানাগুলোতে কারিগররা কাটাচ্ছেন নির্ঘুম রাত। বেড়েছে মৌসুমি কারিগর। তবে বিদেশি আমদানি করা জুতার ভিড়ে দেশি ব্র্যান্ডগুলোর প্রতিযোগিতায় টিকে থাকাই এখন বড় চ্যালেঞ্জ। সংশ্লিষ্টদের দাবি, জুতা আমদানিতে শুল্ক বাড়িয়ে দেশীয় পাদুকাশিল্প ও শ্রমিকদের টিকে থাকতে পাশে দাঁড়াতে হবে সরকারকে।

এ শিল্প সংশ্লিষ্টরা বলছেন, দেশীয় কারখানাগুলোয় সারাবছর কাজ কম থাকে। প্রতিবছর ঈদুল ফিতরে চাহিদা বাড়ে কয়েকগুণ। কাজ কমায় এ পেশা ছেড়ে অন্য পেশায় থিতু হওয়া অনেক কারিগর আবার এক মাসের জন্য যুক্ত হন। চীন, ভারত ও মিয়ানমার থেকে জুতা আমদানির কারণে দেশীয় পাদুকাশিল্প হুমকিতে পড়ছে। ফলে চাহিদা ও মজুরি কম হওয়াসহ নানা কারণে বাধ্য হয়েই এখন কারিগররা এ পেশা ছাড়ছেন।

 ‘দেশের সব মানুষই জুতা পরেন। সে হিসেবে চাহিদাও পুরো বছর থাকার কথা। কিন্তু বিদেশি জুতা আমদানির কারণে দেশীয় পাদুকাশিল্পে ধস নেমেছে’

চট্টগ্রাম নগরের পূর্ব মাদারবাড়ি, পশ্চিম মাদারবাড়ি, অভয়মিত্র ঘাট, আলকরণ, নালাপাড়া জলসা মার্কেট এলাকা ঘুরে দেখা যায়, এসব এলাকায় থাকা প্রায় সাতশ কারখানায় রমজান ঘিরে জুতা তৈরির ধুম পড়েছে। কারখানায় কেউ করছেন কাটিং, কেউ সেলাই, কেউ ফিটিং আবার কেউ ফিনিশিংয়ের কাজে ব্যস্ত। রাত-দিন ২৪ ঘণ্টাই এসব কারখানায় পালা করে চলছে জুতা তৈরির কাজ।

নগরের মাদারবাড়ি নসু মালুম মসজিদ এলাকার কয়েকটি জুতার কারখানায় দেখা গেছে, ছোট কক্ষে বেশ কয়েকজন শ্রমিক সারি বেঁধে জুতা তৈরির কাজ করছেন। যারা রাতে কাজ করেছেন, তাদের কেউ পালা করে ঘুমাচ্ছেন। সে সময়ে অন্যরা জুতা তৈরির কাজ করছেন।

নসু মালুম মসজিদের পাশেই ইউরো সুজের কারখানা। কারখানার কারিগর মো. জাকির আহমদ ৩০ বছর ধরে রয়েছেন এ পেশায়।

তিনি বলেন, পুরো বছর কাজ কম থাকে। রমজান এলে চাহিদা বাড়ে। এখন মৌসুমি কারিগরও আছেন। যারা আগে জুতা তৈরির পেশায় ছিলেন। কাজ কমে যাওয়ায় তারা এখন অন্য পেশায়। রোজা শুরু হলে এক মাসের জন্য আবার এ কাজে আসেন। আমরা দিনে দুই ডজন জুতা তৈরি করতে পারি। এতে শুধু আমার মজুরি আসে আটশ টাকা।

 ‘পাদুকাশিল্প একটি স্বীকৃত কুটির শিল্প হলেও সরকারি কোনো পৃষ্ঠপোষকতা নেই। অন্য অনেক শিল্পকে বিসিক শিল্প নগরীতে স্থান দেওয়া হয়েছে। কিন্তু ক্ষুদ্র পাদুকাশিল্পকে বিসিক-এ স্থান দেওয়া হয়নি’

আরেক কারিগর মিন্টু মিয়া বলেন, ১৯৯২ সালে জুতা তৈরির কাজে এসেছি। এখনো আছি। এখানে যারা স্থায়ী কারিগর, তাদের পুরো বছর কাজ থাকে। তবে আয় কম। পুরো মাসে ১২ থেকে ১৫ হাজার টাকার বেশি আয় করা সম্ভব হয় না।

তিনি বলেন, দেশের সব মানুষই জুতা পরেন। সে হিসাবে চাহিদাও পুরো বছর থাকার কথা। কিন্তু বিদেশি জুতা আমদানির কারণে দেশীয় পাদুকাশিল্পে ধস নেমেছে।

খুলনা বিভাগের বাগেরহাটের বাসিন্দা মো. মাসুদ। ৮-৯ বছর বয়স থেকে জড়িয়ে পড়েন জুতা তৈরির কাজে। তিনি বলেন, এক ফুফাতো ভাইয়ের ঢাকায় জুতার কারখানা ছিল। সেই থেকে হেলপার হিসেবে কাজে আসা। প্রায় ৩৪ বছর কারিগর হিসেবে কাজ করছি।

তিনি বলেন, কয়েকজনের হাত ঘুরে এক জোড়া জুতা তৈরি হয়। কেউ আপার (উপরের অংশ) বানায়, কেউ সোল বানায়, কেউ ফিটিংস করে, আবার কেউ করে ফিনিশিং। কোয়ালিটি অনুসারে একেক ডজন জুতা তৈরিতে চারশ থেকে এক হাজার টাকা পর্যন্ত মজুরি আসে।

রাকিব সুজের রফিকুল ইসলাম জানান, জুতার অধিকাংশ উপকরণ আসে চীন থেকে। বাংলাদেশি সোল (তলা) দিয়েও জুতা তৈরি হচ্ছে। তবে ইন্ডিয়ান, চায়না ও বাার্মিজ ফিটিংস জুতা বেশি আসায় বাংলাদেশি লোকাল পণ্যের চাহিদা কমছে।

‘চীনের জুতা ও বাংলাদেশে ফিটিংস জুতার চেয়ে ভারতীয় জুতায় খরচ কম। যে কারণে ভারতীয় জুতা বাজার দখল করছে।’ এ ব্যবসায়ীর দাবি, আমদানিকৃত এসব জুতায় শুল্ক বাড়ালে দেশীয় পাদুকাশিল্প রক্ষা পাবে।

তিনি বলেন, চট্টগ্রাম ছাড়াও ভৈরব এবং ঢাকায় জুতা তৈরির বড় বড় কারখানা রয়েছে। চট্টগ্রামে সমিতির সদস্য কারখানা আছে চারশ। এখন কারখানার সংখ্যা আরও বেড়েছে। একেক কারখানায় ১৫ থেকে ৫০ জন শ্রমিক রয়েছেন। শুধু ২০ জন করে হিসাব করলে কয়েক হাজার শ্রমিক চট্টগ্রামে কাজ করেন। সারাদেশে পাদুকাশিল্পে জড়িত লক্ষাধিক শ্রমিক। এ শিল্প না বাঁচলে কাজ হারিয়ে বেকার হয়ে পড়তে হবে।

বিদেশি ব্র্যান্ডের দখলে ঈদবাজার, কোণঠাসা দেশীয় জুতা

‘আমাদের তৈরি জুতাও টেকসই। চীন-ভারতীয় জুতাকে আমরা টেক্কা দিতে পারি। আমরা যে জুতা সাড়ে ৯শ টাকায় দিচ্ছি সে জুতা চীন থেকে আনলে দেড় হাজার টাকার কম হবে না। আবার আমরা ছয় মাসের গ্যারান্টি দিচ্ছি।’

এ ব্যবসায়ীর মতে বিদেশি জুতার আগ্রাসনে দেশি পাদুকা শিল্প কোণঠাসা অবস্থায় রয়েছে। এখন দেশে যে জুতা তৈরি করা হয়, তার যাবতীয় কাঁচামাল (তৈরির উপকরণ) ফোম, রাবার, স্টিকার, গাম সবই আসে চায়না থেকে। এখানে শুধু সংযোজন করা হয় মাত্র। অথচ আমাদের দেশে এসব উপকরণ উৎপাদন করার কোনো পদক্ষেপ নেওয়া হচ্ছে না। শুধু উপকরণ নয়, চায়না, থাইল্যান্ড, ভারতীয় তৈরি জুতা আমাদের দেশের বাজার দখল করে নিয়েছে। এতে সব অর্থই বিদেশে চলে যাচ্ছে। আমরা জুতা তৈরি করে শুধু মজুরিটাই পাই।’

পাদুকাশিল্পী জসিম উদ্দিন দিনে আটশ থেকে এক হাজার টাকা আয় করেন বলে জানান। তিনি বলেন, আমাদের কোনো প্রশিক্ষণ দেওয়া হয় না। এখানে সবাই হেলপার হিসেবে কাজে এসে ধীরে ধীরে কাজ শিখেছেন। জুতা কিংবা স্যান্ডেলের ডিজাইন আমরা নিজেরাই করি। শুধু জুতা তৈরির নানা কাঁচামাল কিনে আনতে হয়। সাকসেস সুজ কারখানার মালিক মো. বেলাল  বলেন, চট্টগ্রামে কয়েকশ জুতা তৈরির কারখানা আছে। দোকানিদের চাহিদা মোতাবেক আমরা জুতা তৈরি করি। পাদুকাশিল্প একটি স্বীকৃত কুটির শিল্প হলেও সরকারি কোনো পৃষ্ঠপোষকতা নেই। অন্য অনেক শিল্পকে বিসিক শিল্প নগরীতে স্থান দেওয়া হয়েছে। কিন্তু ক্ষুদ্র পাদুকাশিল্পকে বিসিক-এ স্থান দেওয়া হয়নি। আলাদা কোনো পাদুকাপল্লীও করা হয়নি।

এ ব্যবসায়ী বলেন, আমাদের তৈরি জুতা চট্টগ্রাম মহানগরী ছাড়াও আশপাশের জেলা কক্সবাজার, ফেনী, নোয়াখালী, রাঙামাটি, খাগড়াছড়ি, বান্দরবানের দোকানিরা নিয়ে যান।

‘পাদুকাশিল্পে জড়িতদের কোনো প্রাতিষ্ঠানিক জ্ঞান নেই। তাই এ শিল্পে জড়িতদের সরকারিভাবে প্রশিক্ষণের ব্যবস্থা করা প্রয়োজন। পাদুকাশিল্পের কারিগরদের প্রশিক্ষিত করা গেলে নিত্যনতুন ডিজাইনের জুতা তৈরিসহ সময়ের সঙ্গে তাল মিলিয়ে আধুনিক জুতা তৈরিতে প্রতিযোগিতায় অন্যদের চেয়ে এগিয়ে থাকবে তারা।’

চট্টগ্রাম ক্ষুদ্র পাদুকাশিল্প মালিক গ্রুপের সাধারণ সম্পাদক মো. মোসলেহ উদ্দিন খাঁন  বলেন, করোনার কারণে গত দুই বছর আমাদের কোনো কাজ ছিল না। খরচ চালাতে না পেরে অনেকে কারখানা গুটিয়ে নিয়েছেন। পাদুকাশিল্পের উদ্যোক্তারা প্রণোদনা সুবিধা পাননি। এখনো পুঁজির সংকটে অনেকে বন্ধ কারখানা চালু করতে পারছেন না।

তিনি বলেন, অনেকে ঈদ সামনে রেখে কারখানাগুলো চালু করেছেন। এসব কারখানা স্থায়ী চালু করা না গেলে শ্রমিকরা কাজ হারাবে।

এ বিষয়ে কথা হলে চট্টগ্রাম চেম্বারের পরিচালক মাহফুজুল হক শাহ  বলেন, বাংলাদেশ এখন পোশাকখাতের মতো জুতাও রপ্তানি করছে। রপ্তানি প্রক্রিয়াকরণ অঞ্চগুলোতে (ইপিজেড) জুতার আধুনিক কারখানাও রয়েছে। তবে সনাতন পদ্ধতিতে তৈরি দেশীয় পাদুকাশিল্পকে বাঁচাতে হবে। এ শিল্পে দেশি কারিগররা কাজ করে জীবিকা নির্বাহ করেন। বিদেশি জুতার আড়ালে দেশি এ শিল্পটি যাতে হারিয়ে না যায় সে বিষয়ে সরকারিভাবে পদক্ষেপ নিতে হবে। ক্ষেত্রবিশেষে ফিটিংস জুতা আমদানিতে শুল্ক বাড়ালেও দেশি পাদুকাশিল্প উপকৃত হবে।

About The Author

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *