৭ মার্চের ভাষণে নয়টি ‘মূলমন্ত্র’
1 min readমার্চের শুরু থেকে ছয় দিনে সারা বাংলাদেশব্যাপী বিক্ষোভ-হরতাল আন্দোলনের যে অনন্য ইতিহাস রচনা করেছিল তারই পটভূমিতে এসেছিল ৭ মার্চ । রেসকোর্সে বঙ্গবন্ধুর সেদিনের ভাষণ। স্বাধীনতা পিপাসু জনতা সেদিন জেনে গিয়েছিল, বঙ্গবন্ধুর নির্দেশনা আসছে। পথ-ঘাট-নদী পেরিয়ে মানুষের ঢল নেমেছিল রেসকোর্সে। সেদিনের সভায় বক্তৃতার কী ছিল মূলকথা। অনেক নির্দেশনার মধ্যে প্রধান যে বক্তব্যগুলো মন্ত্র হয়ে সামনে এসেছিল তেমন ৯টি মূল বিষয় মানুষকে সাহস জুগিয়েছিল।
ঠিক এক বছরের মাথায় স্বাধীন বাংলাদেশ থেকে প্রকাশিত দৈনিক বাংলায় মোহাম্মদ জাহাঙ্গীর লিখেছিলেন সেদিন (৭মার্চ ১৯৭১) পথে পথে মিছিল ঝড়ের মতো বয়ে চলে যাচ্ছে। মানুষ এক বুক আশা নিয়ে চলছে।
চারিদিকে গগন বিদারী স্লোগানে বঙ্গবন্ধু আসলেন ৩টা ২০ মিনিটে। স্লোগান চলছে, তুমুলভাবে স্বাধীনতার স্লোগান আপসের বিরুদ্ধে হুঁশিয়ারি। মাওলানা আব্দুর রশিদ তর্কবাগীশ কোরআন তেলোয়াত করলেন। শহীদদের স্মরণে মোনাজাত করা হলো। সভা শুরুর ঘোষণা করেন তাজউদ্দিন আহমেদ। বঙ্গবন্ধুর একমাত্র বক্তা ছিলেন।
একাত্তর পরবর্তী সময়ে বিজ্ঞজনেরা ভাষণে ৯টি মূল বিষয় চিহ্নিত করেছেন নানা সময়ে। সেগুলো হলো, ১. সামরিক শাসন তুলে নিতে হবে; ২. সেনাবাহিনীকে ছাউনিতে নিতে হবে; ৩. ক্ষমতা হস্তান্তর; ৪. সব হত্যার তদন্ত হতে হবে; ৫. এরপরে বিবেচনা করা হবে জাতীয় পরিষদের যাবো কিনা; ৬. রক্ত যখন দিয়েছি তখন রক্ত আরো দেবো তবুও এদেশের মানুষকে মুক্ত করে ছাড়বো ইনশাল্লাহ; ৭. তোমাদের যা কিছু আছে তাই নিয়ে প্রস্তুত থাকো ঘরে ঘরে দুর্গ গড়ে তোল; ৮. আমরা যখন মরতে শিখেছি তখন কেউ আমাদের দাবায়ে রাখতে পারবে না; ৯. এবারের সংগ্রাম মুক্তির সংগ্রাম এবারের সংগ্রাম স্বাধীনতার সংগ্রাম।
সমগ্র বাংলাদেশ যেন সেদিন একটি রূপ নিয়েছিল। রূপ নিয়েছিল একটি জাগ্রত বিবেকে। এদেশের মুক্তিপাগল জনতা ২৩ বছরে পাকিস্তানের শাসন শোষণের যাঁতাকলে নির্যাতিত পরিচিত বাঙালি জাতি মার্চের উত্তপ্ত দিনগুলোতে ভাষা পেয়েছিল। একটি কর্মসূচিতে পথ খুঁজে পেয়েছিল চূড়ান্ত মুক্তির জন্য সশস্ত্র বিপ্লবের।
বঙ্গবন্ধুর কণ্ঠ ভেসে এলো সেই পরিচিত কণ্ঠস্বর ভাইয়েরা আমার আপনারা সবকিছু জানেন এবং বুঝেন। আজ বড় দুঃখ ভারাক্রান্ত হৃদয় নিয়ে আপনাদের সামনে দাঁড়িয়েছি। বঙ্গবন্ধুর বক্তৃতা করে যাচ্ছেন কখনও আবেগ কখনও উত্তেজনায় কখনও খুব প্রতিশোধের স্পৃহা, কখনও কখনও নির্দেশের সুর।
৭ মার্চের ভাষণে কতগুলো যুগান্তরকারী নির্দেশ ছিল। বঙ্গবন্ধু শুধু জনগণের ভালোবাসাকে পুঁজি করে নির্দেশ দিয়েছিলেন স্বাধীনতাকামী বাংলাদেশের জনগণের প্রতি। নির্দেশগুলো ছিল অসহযোগ শুরু, খাজনা-ট্যাক্স বন্ধ থাকবে, বেতার টিভি আমাদের বক্তব্য প্রচার করবে, রেলওয়ে বন্দর চালু হবে, আন্তঃজেলা ট্রাক সার্ভিস চালু থাকবে, ব্যাংকের টাকা পশ্চিম পাকিস্তানের চালান দেওয়া যাবেন, প্রতিটি গ্রামে মহল্লায় আওয়ামী লীগের নেতৃত্বে সংগ্রাম কমিটি গড়ে তুলতে হবে, শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান সেক্টরের সরকারি অফিস বন্ধ থাকবে।
৭ মার্চের ভাষণ একদিকে যেমন নতুন এক ইতিহাসের জন্ম দিয়েছিল তেমনি রেসকোর্সের এই জনসভায় বাংলাদেশের রাজনৈতিক ইতিহাসে এক অনন্য ঘটনা হিসেবে চিহ্নিত। এর পরবর্তীতে স্বাধীন দেশে যেকোনও বিরাট জনসভা হলে তার পরিমাপ রেসকোর্সের ৭মার্চের জনসভার আলোকে বিচার করা রেওয়াজ হয়ে দাঁড়িয়েছিল।
তুখোড় রাজনৈতিক প্রজ্ঞার কারণে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান বুঝতে পারছিলেন যে আগামী দিনগুলোতে কী ঘটতে চলেছে। সামনে ২৫ তারিখের মতো কালো দিন যে বাংলাদেশের জীবন ঘনিয়ে আসছে তা আন্দাজ করতে পেরে ৭ মার্চ জনসভায় তিনি যাবতীয় নির্দেশনা দিয়ে জাতিকে মানসিকভাবে প্রস্তুত করে তুলেছিলেন।