পঞ্চাশোর্ধ্ব এই কৃষক দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে বলেন, “যাওয়ার মতো অবস্থা নাই। এইবার এক্কেরে সর্বনাশের মইধ্যে পড়ছি।“
একই গ্রামের মনির হোসেন (৪০)। তিনি বলেন, “আমার গোলায় প্রায় দুই হাজার মণ ধান। ঘরের মধ্যে তিন থেকে চার ফুট বানের পানি। ধান পানিতে ভেইজ্যা আছে। কী করতাম, কিবায় বাঁচাম।“
একই উপজেলার কাদিরপুর গ্রামের রিপন সরকারের গোলায় থাকা প্রায় ৫০০ মণ ধান এখন পানির নিচে। সেই সঙ্গে গবাদি পশু রাখা নিয়েও পড়েছেন সঙ্কটে।
“আমার আটটা গরু। তারারে সরানির জায়গা নাই। পানির মধ্যেই একটু উঁচু জায়গা দেইখ্যা রাখছি। চোরের ভয়ে নিজেও হেইখানে থাকি।”
গবাদিপশু নিয়ে বিপাকে পড়ার কথা জানালেন খালিয়াজুরী উপজেলা সদরের পাশের উত্তর আঁটিপাড়ার মিন্টু মিয়া, রূপনগর গ্রামের একদিল মিয়া।
একদিল মিয়ার চারটি গরুর মধ্যে একটি শংকর জাতের বড় ষাঁড়। এটা বিক্রি করেই তার সারা বছরের পরিবারের খোরাকি, মহাজনের ঋণ শোধ, ছেলেমেয়েদের পড়াশোনার খরচ চালানোর কথা। এগুলো নিয়ে দুই দিন ধরে উপজেলার ডাকবাংলোর সামনে পড়ে আছেন তিনি। পরিবার উঠেছে খালিয়াজুরী কলেজ আশ্রয়কেন্দ্রে। পানি নামলে পরে বাড়ি ফিরবেন।
মিন্টু মিয়ারও একটি বড় ষাঁড় এবারের কোরবানি ঈদে বিক্রি করার কথা। এখন সেই ষাঁড় তার জন্য গলার ফাঁস হয়ে গেছে। তিনি উঠেছেন খালিয়াজুরী মডেল পাইলট উচ্চ বিদ্যালয়ে আশ্রয়কেন্দ্রে।
তিনি বলছিলেন, “নিজেদের ঘরই ডুবে গেছে, গরু রাখব কোথায়? নিজেদেরই খাবার নেই গরুকে কী খাওয়াব?”
একদিল মিয়া, মিন্টু মিয়ার মতো হাওরে অনেক কৃষক কোরবানির ঈদকে সামনে রেখে পশু লালন-পালন করেছেন। প্রতিবছরই তারা এটা করেন। কৃষির পাশাপাশি এটা তাদের উপার্জনের একটি বড় মাধ্যম। এখন না পারছেন গরু বিক্রি করতে, না পারছেন রাখতে। খোলা আকাশের নিচে এখন গবাদি পশুর সঙ্গে মিলেমিশে দিন খাটাচ্ছেন হাওরবাসী। উপজেলার ছয়টি ইউনিয়নের ৭০টি গ্রামের চিত্র প্রায় একই।
খালিয়াজুরী উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা (ইউএনও) এ এইচ এম আরিফুল ইসলাম বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, “সবচেয়ে সব সমস্যা হচ্ছে, মানুষের গবাদিপশু ও সারা বছরের জমা ধান রয়েছে বাড়িতে। এ নিয়ে মানুষ খুব বিপদে আছেন। এগুলো রেখে তারা আশ্রয়কেন্দ্রে আসতে চাচ্ছেন না।
এখন বড় নৌকাও পাওয়া যাচ্ছে না। উপজেলা প্রশাসন একটা বড় নৌকা সংগ্রহ করেছে। এটা দিয়ে অভিযান শুরু হয়েছে। মানুষকে আশ্রয়কেন্দ্রে নিয়ে আসার চেষ্টা হচ্ছে।”
ইউএনও আরও বলেন, উপজেলার সবচেয়ে বেশি খারাপ অবস্থা রুয়াইল, মোমিনপুর, যোগীনগর, মুজিবনগর, আদাউড়া, আদিতপুর এলাকায়। ৫২টির বেশি আশ্রয়কেন্দ্র খোলা হয়েছে। ২০ হাজারের বেশি মানুষ পানিবন্দি রয়েছে।
“অবস্থা এমন পর্যায়ে গেছে যে, ইউএনও কার্যালয় এবং উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সেও আমরা আশ্রয়কেন্দ্র খুলেছি। বানভাসিরা গরু, ছাগল, হাঁস-মুরগি এবং সহায়-সম্পদ নিয়ে সেখানে আশ্রয় নিয়েছেন। আমরা তাদের শুকনা খাবার সরবরাহ করেছি।“
সুনামগঞ্জ ও সিলেটের পাশের হাওরাঞ্চলের জেলা নেত্রকোণায় প্রতিদিন বন্যা পরিস্থিতির অবনতি হচ্ছে। জেলার ১০টি উপজেলার মধ্যে ছয়টিই এর মধ্যে প্লাবিত হয়েছে। সবচেয়ে বেশি প্লাবিত হয়েছে হাওর সংলগ্ন খালিয়াজুড়ি, কলমাকান্দা ও মোহনগঞ্জের বিস্তীর্ণ এলাকা।
জেলা প্রশাসক আরও জানান, ৮৯ মেট্রিক টন চাল, নগদ তিন লাখ টাকা এবং এক হাজার ৩০০ প্যাকেট শুকনো খাবার বিতরণ করা হচ্ছে। বন্যা মোকাবেলায় বর্তমানে ৬৯ মেট্রিক টন চাল, নগদ আড়াই লাখ টাকা ও এক হাজার ১৫০ প্যাকেট শুকনো খাবার মজুদ রয়েছে।