বিশ্বের সবচেয়ে ঘুমবঞ্চিত মানুষদের তালিকায় দক্ষিণ কোরীয়দের অবস্থান উপরের দিকে। দেশটিতে ঘুমের ওষুধে আসক্তি চলে গেছে মহামারী পর্যায়ে। তারপরও অনেকেই একগাদা ওষুধ খেয়েও ঘুমোতে পারে না। এই নিদ্রহীনতা দেশটির মোট জনসংখ্যার বড় একটি অংশকে গ্রাস করেছে।
রাজধানী সিউলের ঝা-চকচকে গ্যাংনাম জেলার ড্রিম স্লিপ ক্লিনিকের মনোরোগ বিশেষজ্ঞ ডা. জি-হিয়্যুন লি বলেন, তার কাছে প্রায়ই এমন সব মানুষ আসেন যাদের কেউ কেউ রাতে ২০টি পর্যন্ত ঘুমের ওষুধ খান।তিনি বলেন, “সাধারণত, বিছানায় গেলেই আপনার সঙ্গে সঙ্গে ঘুম আসবে না, একটু সময় লাগবে। কিন্তু কোরিয়ার মানুষ দ্রুত ঘুমিয়ে পড়তে চায়, তাই তারা ঘুমের ওষুধ খায়।”
ঘুমের ওষুধে আসক্তি দক্ষিণ কোরিয়ায় মহামারীর পর্যায়ে চলে গেছে। কোনও সরকারি পরিসংখ্যান না থাকলেও আনুমানিক হিসাবে এক লাখ কোরিয়ান ঘুমের ওষুধে আসক্ত।
তবুও যখন তাদের চোখে ঘুম নেমে আসে না, তখন তারা ওষুধের ওপর অ্যালকোহলও পান করে, এতে পরিস্থিতি আরও বিপজ্জনক মোড় নেয়।ডা. জি-হিয়্যুন লি বলেন, “লোকজন ঘুমের মধ্যে হাঁটা শুরু করে। তারা ফ্রিজের দিকে হেঁটে যায় এবং অবচেতন মনেই প্রচুর খাবার খেয়ে ফেলে। এমনকী কখনও কখনও তারা কাঁচা খাবারও খেয়ে ফেলে।” স্লিপওয়াকিং রোগীদের কারণে সিউলে গাড়ি দুর্ঘটনার মত ঘটনাও ঘটেছে।”দীর্ঘদিন ধরে অনিদ্রায় ভুগছেন এমন রোগীদেরও চিকিৎসা দিয়ে আসছেন ডা. লি। তাদের কয়েকজন তাকে বলেছেন, তারা শেষ কবে রাতে কয়েকঘণ্টা ঘুমিয়েছেন মনে করতে পারেন না। হয়ত সেটা দশক আগে।”তারা কাঁদতে থাকে। তবু অনেক আশা নিয়ে তারা এখানে আসে। এটা সত্যিই খুবই দুঃখজনক পরিস্থিতি।”
অত্যধিক পরিশ্রম, অবসাদ এবং নিদ্রাহীনতাবিশ্বের সবচেয়ে নিদ্রাবঞ্চিত জাতির অন্যতম দক্ষিণ কোরিয়া। উন্নত দেশগুলোর মধ্যে দক্ষিণ কোরিয়ায় আত্মহত্যার প্রবণতাও বেশি। বিশ্বের মধ্যে সেখানকার মানুষরা সবচেয়ে বেশি মদ পান করে এবং প্রচুর মানুষ বিষন্নতারোধী ওষুধ সেবন করে।
এসবের ঐতিহাসিক কারণ রয়েছে। মাত্র কয়েক দশকে দক্ষিণ কোরিয়া পৃথিবীর অন্যতম গরিব দেশ থেকে বিশ্বের অন্যতম প্রযুক্তি নির্ভর উন্নত দেশে পরিণত হয়েছে। পপসঙ্গীতে তারা বিশ্বব্যাপী প্রভাব বিস্তার করছে।
সৌদি আরব এবং সংযুক্ত আরব আমিরাতের মতো একই পথে হেঁটেছে তারা। কিন্তু ওই দুই দেশের মতো দক্ষিণ কোরিয়া প্রাকৃতিক সম্পদের ওপর নির্ভরশীল নয়।
কোরিয়ার হাতে এমন কোনও লুকানো সম্পদ নেই। বরং কোরিয়ার নাগরিকরা কঠোর ও দ্রুত পরিশ্রমের মাধ্যমে নিজেদের এই পরিবর্তন ঘটিয়েছে। একটি সম্মিলিত জাতীয়বাদের মাধ্যমে তারা নিজেদের উৎসর্গ করেছে।
কিন্তু অমানুষিক পরিশ্রমের ফলে উন্নতির পাশপাশি এসেছে অবসাদ এবং নিদ্রাহীনতা। দক্ষিণ কোরিয়ার তরুণদের একটি বড় অংশ তাদের ঘুমের সমস্যা নিয়ে সাহায্য চাইছে এবং এই সংখ্যা দিন দিন বাড়ছে।
অবাক করা বিষয় হল, এই নিদ্রাহীনদের ঘিরেও দক্ষিণ কোরিয়ায় সম্পূর্ণ আলাদা একটি শিল্প গড়ে উঠেছে- ২০১৯ সালে এই ঘুম শিল্প ঘিরে ২৫০ কোটি মার্কিন ডলারের বাণিজ্য হয়েছে।
বাড়ছে ঘুম নিয়ে বাণিজ্য
সিউলে শুধু ঘুমের জন্য সহায়ক সামগ্রী নিয়ে একেকটি ডিপার্টমেন্টাল স্টোর গড়ে উঠেছে। ঘুম আনতে সহায়ক বিছানার চাদর থেকে শুরু করে উচ্চমানের বালিশ, ভেষজ ঔষধ, টনিক- কী নেই সেখানে!
পিছিয়ে নেই প্রযুক্তিও। ইনসোমনিয়া বা অনিদ্রা দূর করতে নেওয়া হয়েছে প্রযুক্তির সহায়তা। বছর দুয়েক আগে ড্যানিয়েল টিউডর নামক একজন ‘কোক্কিরি’ নামের একটি মেডিটেশন অ্যাপ চালু করেন- দাবি করা হয়, কোরিয়ার তরুণদের মানসিক চাপ দূর করতে সহায়ক সেই অ্যাপ।
কোরিয়ার অধিবাসীদের একটি বড় অংশ বৌদ্ধ ধর্মাবলম্বী। অথচ দেশটির তরুণরা মেডিটেশন করাকে বয়স্কদের বিনোদন হিসেবে গণ্য করে! তাদের মতে, সিউলের অফিস কর্মীদের জন্য এসব ধ্যান-ট্যান কোনও কাজের কিছু নয়।
ড্যানিয়েল বলেন, তরুণ কোরিয়ানদের কাছে অ্যাপটিকে আকর্ষণীয় হিসেবে প্রচার করতে তাকে মেডিটেসনকে একটি পশ্চিমা ধারণা হিসাবে পুনঃপ্রতিষ্ঠিত করতে হয়েছিল। অনেক ঐতিহ্যবাহী প্রতিষ্ঠানও এ কাজে জড়িত হয়েছে এখন।
অতীতে এ ধরনের প্রবণতা অবসর নেওয়া লোকেদের মধ্যে দেখা যেত। অবসরের পর তারা ধর্মচর্চা এবং প্রার্থনায় সময় অতিবাহিত করতে চাইতেন। কিন্তু এখন যাদের দেখা যায়, তারা বেশিরভাগই বয়সে তরুণ এবং কর্মী।
হিয়েরাং সুনিম বলেন, “ঐতিহ্যগতভাবে অল্পবয়সীদের বৌদ্ধধর্ম শিক্ষা গ্রহণ করতে দেখাটা বিরল। কিন্তু মন্দিরে অবস্থানের সময়টাতে তারা অনেক কিছুর সংস্পর্শে আসতে পারে।”
প্রয়োজন মৌলিক পরিবর্তন
অধিক কাজের চাপে পিষ্ট লি হিয়ে-রি, এমনই একটি বৌদ্ধচর্চা কেন্দ্রে যোগ দিয়েছিলেন। সেখানে তিনি কিভাবে নিজের চাপের দায়িত্ব নিতে হয় তা শিখেছেন বলে জানান।
লির মতে, “সবকিছু আসলে আমার থেকেই উৎপত্তি লাভ করেছে। সব সমস্যার শুরুটা আমার মাধ্যমেই। এটাই সেখানে শিখেছি আমি।”
কিন্তু এভাবে মানসিক চাপ এবং অনিদ্রাজনিত সমস্যাকে কারও ব্যক্তিগত সমস্যা হিসেবে রূপ দেওয়াটা কারো কারো কাছে আপত্তিকর ঠেকেছে।
যেসব কোরিয়ান বিশ্বাস করেন যে, ঘুমের এ সমস্যা অযৌক্তিক কাজের সংস্কৃতি এবং সামাজিক চাপ থেকে সৃষ্ট- তারা এই ব্যক্তিবাদী দৃষ্টিভঙ্গির সমালোচনা করেছেন। তাদের মতে, এটি আসলে ‘ভিকটিম-ব্লেমিং’ এর সমতুল্য।
এই সমালোচকরা বলেছেন, ধ্যান বা মেডিটেশন নয়, প্রকৃত সমাধান শুধুমাত্র সমাজে মৌলিক পরিবর্তনের মাধ্যমেই আসতে পারে।
কেউ কেউ নিদ্রাহীনতার সমস্যা সমাধানের পথ নিজেই খুঁজে নিয়েছেন। যেমন লেখার শুরুতে বলা জনসংযোগ কর্মকর্তা জি-হিউন। কাজের অতিরিক্ত চাপ নিতে না পেরে তিনি চাকরিই ছেড়ে দিয়েছেন।
এখন তিনি ফ্রিল্যান্সার হিসেবে কাজ করেন। ফলে কর্মঘণ্টাও নিজের সুবিধা মত ঠিক করতে পারেন। করোনাভাইরাস মহামারীর মধ্যে তিনি ঘরে বসে কাজের সুবিধাও পেয়েছেন।
তিনি বলেন, ‘‘দেশে গড়ার কাজ তো অনেক হল, এখন আর এত পরিশ্রম করে কী হবে? আমদের এখন একটু বিশ্রাম করা উচিত।”