টেক্সটাইল শিল্পে নেতৃত্ব দেবে বাংলাদেশ
1 min readটেক্সটাইল শিল্পে বাংলাদেশের প্রধান প্রতিযোগী ভারত। দেশটির অর্থনীতিতে টেক্সটাইল শিল্পের গুরুত্ব অপরিসীম। তবে কয়েক বছর ধরে ভারতে টেক্সটাইল ব্যবসা খুব একটা ভালো যাচ্ছে না। ২০১৫ থেকে ২০১৯ সালে দেশটির টেক্সটাইল পণ্য রপ্তানি কমে ৩ শতাংশ। ২০২০ সালে এর হার দাঁড়ায় ১৮ দশমিক ৭ শতাংশ। বাংলাদেশ ও ভারত থেকে ক্রয়াদেশ বাতিল করে ক্রেতারা পাকিস্তানের দিকে ঝোঁকায় রেকর্ড গড়ছে দেশটির তৈরি পোশাক রপ্তানি। এক বছর আগের তুলনায় ৪০ শতাংশ বেড়ে রেকর্ড ২১ বিলিয়ন মার্কিন ডলার হওয়ার সম্ভাবনা রয়েছে।
একই সময় বাংলাদেশ-ভিয়েতনামের মতো সাশ্রয়ী দেশগুলো ব্যবসা করেছে আশাতীত। দেশীয় খাত সংশ্লিষ্টরা বলছেন, বাংলাদেশের চেয়ে ৩০ শতাংশ পর্যন্ত গ্যাসের দাম বেশি হলেও ভারতে টেক্সটাইল শিল্পের প্রধান কাঁচামাল সুতার দাম প্রায় ২০ শতাংশ কম। একই সঙ্গে কম ডাইস কেমিক্যালের দামও। ফলে গ্যাস বা বিদুৎ বিল সমন্বয় করার পরও বাংলাদেশের চেয়ে তাদের খরচ কম হবে। তবে ভারত বা পাকিস্তানে বায়ার (বিদেশি ক্রেতা) ফিরে গেলেও বাংলাদেশের পণ্যের কোয়ালিটি ভালো। পোশাকশিল্পের সক্ষমতার ওপর বায়ারদের আস্থা অনেক বেশি। এ শক্তি কাজে লাগিয়ে আগামীতে পোশাকশিল্প বিশ্ববাজারে নেতৃত্ব দেবে দেশ— এমনটাই আশা দেশীয় শিল্প উদোক্তাদের।
ভারতীয় সংবাদমাধ্যম দ্য ইকোনমিক টাইমসের এক প্রতিবেদন বলছে, ভারতের টেক্সটাইল ব্যবসা খুব একটা ভালো যাচ্ছে না। ২০১৫ থেকে ২০১৯ সালে দেশটির টেক্সটাইল পণ্য রপ্তানি কমেছে ৩ শতাংশ। ২০২০ সালে তা দাঁড়িয়েছে ১৮ দশমিক ৭ শতাংশে। কারণ হিসেবে বলা হচ্ছে, বাড়তি খরচ ভারতের টেক্সটাইল শিল্পের জন্য বড় সমস্যা। বাংলাদেশের তুলনায় ভারতে বিদ্যুৎ খরচ ৩০ থেকে ৪০ শতাংশ বেশি। প্রধান আমদানিকারকদের সঙ্গে ভারতের মুক্ত অথবা অগ্রাধিকার বাণিজ্যচুক্তির অভাব রয়েছে। পোশাকের জন্য ইউরোপীয় ইউনিয়ন, যুক্তরাজ্য, কানাডা ও কাপড়ের জন্য বাংলাদেশের সঙ্গে এ ধরনের কোনো চুক্তি না থাকা রপ্তানিকারকদের ওপর বাড়তি দামের বোঝা চাপিয়ে দিচ্ছে ভারত। ভারতে উচ্চ মূলধন ব্যয় এবং প্রায় সব টেক্সটাইল যন্ত্রপাতির আমদানিনির্ভরতা সন্তোষকজনক মুনাফা অর্জনকে কঠিন করে তুলেছে। চীনা প্রস্তুতকারকদের তুলনায় উৎপাদনে বাড়তি সময় নেওয়া ভারত প্রতিযোগিতার দৌড়ে পিছিয়ে।
পশ্চিমা দেশগুলোর তুলনামূলক কাছাকাছি উৎপাদনকেন্দ্রে বিনিয়োগের প্রবণতাও ভারতের টেক্সটাইল শিল্পের জন্য ক্ষতির কারণ হয়ে দাঁড়িয়েছে। আমদানিকারকদের সঙ্গে মুক্ত অথবা অগ্রাধিকার বাণিজ্যচুক্তি করা, সেবা খাতগুলোর সংস্কার, ডিজিটালাইজেশন, সক্ষমতা বাড়ানো ও স্থায়ী বিনিয়োগ। টেক্সটাইল শিল্পে আগামী পাঁচ বছরে ভারতের পারফরম্যান্স-পরবর্তী বহু বছরের গতি নির্ধারণ করতে পারে। বিশ্ববাজারে অবস্থান ও লাখ লাখ কর্মসংস্থান ঝুঁকিতে থাকায় ভারতকে দ্রুত ব্যবস্থা নিতে হবে। অথচ একই সময়ে বাংলাদেশ-ভিয়েতনামের মতো সাশ্রয়ী দেশগুলো ব্যবসা করেছে আশাতীত।
মার্কিন সংবাদমাধ্যম ব্লুমবার্গের এক প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, ভঙ্গুর প্রায় অর্থনীতিতে চাঙাভাব ফিরিয়ে আনছে পাকিস্তানের টেক্সটাইল শিল্প। মহামারিতে এশিয়ার প্রতিদ্বন্দ্বী দেশের আদেশ বাতিলের সুযোগে রপ্তানির রেকর্ড গড়তে যাচ্ছে দেশটি। রপ্তানি এক বছর আগের তুলনায় ৪০ শতাংশ বেড়ে দেশটি রেকর্ড ২১ বিলিয়ন মার্কিন ডলার হওয়ার প্রত্যাশা করছে। আগামী আর্থিক বছরে রপ্তানির এ চিত্র বেড়ে ২৬ বিলিয়ন ডলারে দাঁড়াবে বলে প্রত্যাশা করছে দেশটি। ২০২০ সালে করোনাভাইরাস মহামারিতে ভারত এবং বাংলাদেশের কারখানা বন্ধ থাকলেও আগেই কারখানা খুলে দেয় পাকিস্তান। ফলে টার্গেট করপোরেশন ও হ্যানসব্র্যান্ডের মতো বৈশ্বিক বিভিন্ন ব্র্যান্ড প্রতিষ্ঠানের ক্রয়াদেশ পায় পাকিস্তান। মনে করা হচ্ছে এতে দেশটির দুর্বল অর্থনীতি চাঙা করে তুলবে এ শিল্প।
অন্যদিকে ২০২১-২২ অর্থবছরের জুলাই-জানুয়ারি রপ্তানি তথ্য প্রকাশ করেছে বাংলাদেশ রপ্তানি উন্নয়ন ব্যুরো (ইপিবি)। প্রকাশিত প্রতিবেদন অনুযায়ী, পোশাক রপ্তানি প্রবৃদ্ধি ঘুরে দাঁড়ানোর ধারা অব্যাহত রয়েছে দেশের।
সবশেষ প্রাপ্ত তথ্যানুযায়ী, ২০২০-২১ অর্থবছরের জুলাই-জানুয়ারি মাসের রপ্তানির তুলনায় ২০২১-২২ অর্থবছরের একই মাসে রপ্তানি ৩০ দশমিক ৩০ শতাংশ বেড়েছে। ২০২১ এর ডিসেম্বর মাসে ৪ দশমিক শূন্য ৪ বিলিয়ন ডলার সমমূল্যের পোশাক রপ্তানি হয়েছিল, আর জানুয়ারিতে তা কিছুটা বেড়ে ৪ দশমিক শূন্য ৮ বিলিয়ন ডলারে পৌঁছেছে।
পণ্যের ক্যাটাগরি অনুযায়ী, জুলাই-জানুয়ারি সময়ে নিটওয়্যার পণ্য রপ্তানিতে ৩২ দশমিক ৮৯ শতাংশ প্রবৃদ্ধি অর্জিত হয়েছে। অন্যদিকে, ওভেন পোশাকের রপ্তানি বেড়েছে ২৭ দশমিক ২৩ শতাংশ। ফলে সব পণ্যের রপ্তানিতে ইতিবাচক ধারা অব্যাহত আছে। তবে রপ্তানির এ উল্লম্ফন কোভিড-পরবর্তী বাজারের পরিবর্তনের কারণে সৃষ্ট বলে মনে করছেন পোশাক শিল্প উদ্যোক্তারা।
এ বিষয়ে তৈরি পোশাক মালিক ও রপ্তানিকারক সমিতির (বিজিএমইএ) পরিচালক মহিউদ্দিন রুবেল বলেন, পোশাকখাতে রপ্তানির ইতিবাচক ধারা লক্ষ্য করা গেলেও অনেক চ্যালেঞ্জও রয়েছে। বিভিন্ন কাঁচামাল যেমন- টেক্সটাইল, পণ্য জাহাজীকরণ খরচ, রং ও রাসায়নিক দ্রব্যের বাজার অনেক চড়া। কিন্তু পণ্য উৎপাদন খরচ বৃদ্ধির অনুপাতে পোশাকের দাম সামঞ্জস্যপূর্ণভাবে বাড়ছে না। এছাড়া আমাদের পোশাক রপ্তানির প্রধান বাজারগুলোতে কোভিডের নতুন ভ্যারিয়েন্টের সংক্রমণ সুনামির মতো ছড়িয়ে পড়ছে। তাই ভবিষ্যতের বাজারের পূর্বাভাস দেওয়া কঠিন। আগামীতে সংক্রমণের গতি প্রকৃতির ওপর নির্ভর করবে এ ধারা কতটা অব্যাহত থাকে। তবে সুযোগ আরও বেশি কাজে লাগাতে সবচেয়ে বেশি প্রয়োজন এখন সাপ্লাই চেইন ঠিক রেখে সক্ষমতা বাড়ানো। এটা করতে পারলে আগামীতে বাংলাদেশের পোশাক শিল্প বিশ্ববাজারে নেতৃত্ব দেবে।
ভারতে গ্যাসের দাম বাড়ায় সেখানে অনেক শিল্প বন্ধের উপক্রম, বিশেষ করে টেক্সটাইল শিল্প। সেখানে গ্যাস-বিদ্যুতের মূল্যবৃদ্ধি, রপ্তানি কমে যাওয়া, একই সময়ে পাকিস্তানের পোশাক শিল্পে ক্রেতার রপ্তানি আদেশ পাওয়া ও রপ্তানি বাড়ার বিষয়ে কথা হয় বাংলাদেশ গার্মেন্টস ম্যানুফ্যাকচারার্স অ্যান্ড এক্সপোর্টার্স অ্যাসোসিয়েশনের (বিজিএমইএ) সহ-সভাপতি ফজলে শামী এহসানের সঙ্গে।
তিনি বলেন, ভারতে বাংলাদেশের চেয়ে ৩০ শতাংশ পর্যন্ত গ্যাসের দাম বেশি। তবে শিল্পের প্রধান কাঁচামাল সুতার মূল্য আমাদের চেয়ে প্রায় ২০ শতাংশ কম। সেখানে ডাইস কেমিক্যালের দামও কম। ফলে গ্যাস বা বিদুৎ বিল সমন্বয় করেও তাদের খরচ কম হবে, আমাদের চেয়ে বেশি না। আবার পাকিস্তানের সরকারপ্রধান ইমরান খান প্রতি মাসে অর্থনীতিবিদ ও রপ্তানিকারদের সঙ্গে বসেন, সমস্যা-সম্ভাবনা নিয়ে খোঁজ-খবর নেন। এতে রপ্তানিকারকরা তাদের সমস্যাগুলো সরকারের কাছে জানাতে পারে, পলিসি শেয়ার করার সুযোগ রয়েছে। আমাদের দেশের সুতার দাম বেশি। তবে ভারত বা পাকিস্তান থেকে বাংলাদেশের পোশাক শিল্পের সক্ষমতার ওপর বায়ারদের আস্থা অনেক বেশি, সেটা আমাদের প্রধান শক্তি।
তিনি বলেন, কিছু কিছু বায়ার বাংলাদেশের বিকল্প হিসেবে পাকিস্তানকে গড়ে তুলতে চেষ্টা করছে। যারা চলে গেছে তাদের ফিরিয়ে আনার কিছু নেই। তারা তাদের ব্যবসার পলিসির কারণে বাংলাদেশের সঙ্গে অন্য দেশ রাখতে চাইছে। শুধু বাংলাদেশের ওপর নির্ভরশীলতা রাখতে চায় না। করোনা মহামারি চ্যালেঞ্জ ভালোভাবে মোকাবিলা করায় আমাদের রপ্তানি বেড়েছে। এখন মাসে প্রায় পাঁচ বিলিয়ন ডলারের পণ্য রপ্তানি হচ্ছে। রপ্তানির এ ঊর্ধ্বমুখী ধারা আরও বাড়াতে বেশকিছু চ্যালেঞ্জও রয়েছে। তবে অবশ্যই সার্ভিস ও কোয়ালিটি দিয়ে আমরা সিংহভাগ অর্ডার আমাদের দেশে রাখতে পারবো বলে আমার বিশ্বাস।