৫০ বছরের বাংলাদেশ ওষুধে স্বয়ংসম্পূর্ণ
1 min readবাংলাদেশ ওষুধে প্রায় স্বয়ংসম্পূর্ণ। প্রয়োজনীয় ওষুধের ৯৭ শতাংশ দেশেই তৈরি হচ্ছে। জাতিসংঘের শিক্ষা ও বিজ্ঞানবিষয়ক সংস্থা ইউনেসকো এ সপ্তাহে প্রকাশিত তাদের বিজ্ঞান প্রতিবেদনে বলেছে, বিশ্বের স্বল্পোন্নত দেশগুলোর মধ্যে বাংলাদেশ সবচেয়ে বড় ওষুধ রপ্তানিকারক দেশ।
বাংলাদেশের ওষুধ শুধু শ্রীলঙ্কা, নেপাল, ভিয়েতনাম বা আফ্রিকার কিছু দেশে রপ্তানি হচ্ছে, তা নয়। এ দেশের তৈরি ওষুধ যুক্তরাষ্ট্রে ও ইউরোপের বাজারেও রপ্তানি হচ্ছে। সব মিলে শতাধিক দেশে ওষুধ রপ্তানি হয়েছে। মানসম্পন্ন ওষুধ হওয়ায় এটা সম্ভব হয়েছে। ওষুধের পরিমাণগত ও গুণগত মানের এই উন্নতি আন্তর্জাতিক অঙ্গনে বাংলাদেশের সুনাম বাড়িয়েছে।
দেশ যখন স্বাধীন হয় অর্থাৎ ৫০ বছর আগে পরিস্থিতি এমন ছিল না। স্বাধীনতার সুবর্ণজয়ন্তী উপলক্ষে বাংলাদেশ হেলথ ওয়াচ ও প্রথমার যৌথ উদ্যোগে প্রকাশিতব্য স্বাধীনতার পঞ্চাশ বছর: স্বাস্থ্য খাতে অর্জন গ্রন্থে বলা হয়েছে, ১৯৭২ সালে ওষুধের বাজার ছিল ১০০ কোটি টাকার কম। এর মধ্যে ৯০ শতাংশ ছিল আমদানি করা ওষুধ।
ওষুধনীতির আগে সরকার ১৯৭৪ সালে ঔষধ প্রশাসন পরিদপ্তর গঠন করে। তারও আগে ১৯৭৩ সালে প্রয়োজনীয় ওষুধ আমদানি করার জন্য ট্রেডিং করপোরেশন অব বাংলাদেশের অধীনে একটি সেল গঠন করা হয়েছিল।
১৯৮২ সালের ওষুধনীতি
১৯৮২ সালের নীতিতে দেশি ওষুধশিল্পের বিকাশে সবচেয়ে বেশি গুরুত্ব দেওয়া হয়েছিল। এই নীতির কারণে দেশে সহজ প্রযুক্তির ওষুধ আসা শুরু হয়। তালিকা করে দেড় হাজারের বেশি ওষুধ দেশে নিষিদ্ধ করা হয়। বলা হয়েছিল, যেসব ওষুধ দেশি কোম্পানিগুলো তৈরি করতে পারে সেসব ওষুধ আমদানি করা যাবে না। এগুলো ছিল ওষুধশিল্প পর্যায়ক্রমে স্বয়ংসম্পূর্ণ হওয়ার পেছনের কারণ।
ওষুধনীতি হওয়ার পর ট্যাবলেট, ইনেজকট্যাবল, ক্যাপসুল, অ্যান্টিবায়োটিকের মূল্য নিয়ন্ত্রণের ব্যবস্থা করা হয়। এর ফলে ওষুধ থেকে অধিক বা অনৈতিক মুনাফা করার পথ অনেকটা বন্ধ হয়ে যায়।
১৯৮২ সালের ওষুধনীতিতে ১৫০টি ওষুধকে অত্যাবশ্যকীয় ওষুধ হিসেবে তালিকাভুক্ত করা হয়। কোম্পানিগুলোর মোট উৎপাদনের ৬০ শতাংশ অত্যাবশ্যকীয় ওষুধ উৎপাদনকে বাধ্যতামূলক করা হয়।
দেশি ওষুধশিল্প
স্বাধীনতার আগে দেশে দেশি ওষুধ কোম্পানি ছিল দুটি। আর দেশে এখন নিবন্ধন করা ওষুধ কোম্পানি আছে ২৭৪টি। বাংলাদেশে ওষুধশিল্প সমিতি জানিয়েছে, এর মধ্যে ২১৪টি কোম্পানি এখন চালু আছে।
ওষুধশিল্পের সঙ্গে সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিরা বলছেন, ওষুধ উৎপাদনের জন্য দরকার প্রযুক্তি তথা যন্ত্রপাতি। আর দরকার বিনিয়োগ ও জনবল। বাংলাদেশে এর কোনোটির ঘাটতি দেখা যাচ্ছে না।
ওষুধশিল্প সমিতির সভাপতি সাংসদ নাজমুল হাসান বলেন, ওষুধ তৈরি করার জন্য বিশেষায়িত দক্ষ জনবল দরকার হয়। তাদের মধ্যে আছে, ফার্মাসিস্ট, কেমিস্ট ও মাইক্রোবায়োলজিস্ট। বাংলাদেশে এ ধরনের জনবলের অভাব নেই। ওষুধশিল্প বিকাশে এটা বড় শক্তি।
অ্যালোপ্যাথি ওষুধ কোম্পানিগুলো বছরে প্রায় ৩০ হাজারের বেশি বিভিন্ন ধরনের ওষুধ তৈরি করে। এ ছাড়া ১২ হাজারের বেশি ধরনের আয়ুর্বেদিক, ইউনানি ও হারবাল ওষুধ তৈরি হচ্ছে।
ওষুধের বাজারও এখন অনেক বড়। বাংলাদেশের মানুষের আয়সীমা বেড়ে যাওয়ার সঙ্গে সঙ্গে ওষুধের বাজারও বাড়ছে। ২০১২ সালে ওষুধের বাজার ছিল ৯ হাজার কোটি টাকার। ২০১৯ সালে তা বেড়ে ২৫ হাজার কোটি টাকাতে দাঁড়ায়।
দেশের প্রয়োজন মেটানোর পাশাপাশি ওষুধ এখন বিদেশে রপ্তানি হচ্ছে। রপ্তানি আয়ের তৃতীয় বৃহত্তম খাত এখন ওষুধশিল্প। ২০১৪ সালে ওষুধ রপ্তানি করে বাংলাদেশের আয় ছিল ৬৯ দশমিক ২ মিলিয়ন মার্কিন ডলার। ছয় বছর পর আয় বেড়ে প্রায় দ্বিগুণ হয়। ২০২০ সালে ওষুধ রপ্তানি করে আয় ছিল ১৩৫ দশমিক ৮ মিলিয়ন মার্কিন ডলার। বাংলাদেশে উৎপাদিত ওষুধের ৮০ শতাংশ জেনেরিক এবং ২০ শতাংশ পেটেন্টেড।
অপার সম্ভাবনা
ওষুধশিল্প আরও অনেক বড় হওয়ার সম্ভাবনা আছে বলে মনে করেন ওষুধশিল্প সমিতির সভাপতি নাজমুল হাসান। তিনি বলেন, ‘আমরা কোভিড রোগীর চিকিৎসার ওষুধ তৈরি করতে পেরেছি। এটা অনেকের কাছে বিস্ময়ের ছিল। কাঁচামাল উৎপাদনে সক্ষম হলে আমরা আরও অনেক কিছু করতে পারব।’
ওষুধশিল্পের একটি প্রধান সমস্যা কাঁচামাল। ওষুধ প্রস্তুতকারী প্রতিষ্ঠানগুলোকে কাঁচামাল আমদানি করতে হয়। তবে সেই সমস্যা দূর করার উদ্যোগ নিয়েছে সরকার ও ওষুধ প্রস্তুতকারক প্রতিষ্ঠানগুলো।
২০১৮ সাল প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ওষুধ ও ওষুধের কাঁচামালকে ‘প্রোডাক্ট অব দ্য ইয়ার’ ঘোষণা করেন। মুন্সিগঞ্জের গজারিয়ায় একটি এপিআই (অ্যাকটিভ ফার্মাসিউটিক্যাল ইনগ্রিডিয়েন্ট) পার্ক তৈরি করা হচ্ছে। সেখানে ওষুধের কাঁচামাল তৈরি করা হবে। ইতিমধ্যে বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানকে প্লট বরাদ্দ দেওয়া হয়েছে। অনেকে কারখানা তৈরির কাজ শুরু করেছেন। এখানে কাঁচামাল উৎপাদন শুরু হলে দেশের ওষুধশিল্প আরও অনেক দূর এগিয়ে যাবে।