বাংলাদেশ ও ভারতের উন্নততর সামরিক সম্পর্ক
1 min readনতুন ইতিহাস রচিত হলো ভারত-বাংলাদেশ সম্পর্কের। নতুন দিল্লিতে ২৬ জানুয়ারি, ভারতের প্রজাতন্ত্র দিবসের কুচকওয়াজে অংশ নিলেন বাংলাদেশের তিন বাহিনীর ১২২ জন সদস্য। এর আগে ভারতীয় সেনা, এনসিসি ও অবসরপ্রাপ্ত সেনাদের একটি দল বাংলাদেশের বিজয় দিবস কুচকাওয়াজে অংশ নেয়। ফলে প্রতিরক্ষা ক্ষেত্রেও বন্ধুত্বের গন্ডি আরও সুদৃঢ় হলো।
বাংলাদেশের স্বাধীনতার সুবর্ণ জয়ন্তীতে উভয় দেশই চাইছে সামরিক সম্পর্ককেও উন্নত করতে। ৫০ বছর আগে, বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধে ভারতীয় সেনাদের সক্রিয় সহযোগিতার কথা মাথায় রেখে উভয় দেশই বন্ধুত্বকে আরও এগিয়ে নিয়ে যেতে চায়। ভারত সম্মান জানালো মহান মুক্তিযুদ্ধের সুবর্ণ জয়ন্তীকে। উল্লেখ্য, একাত্তরের মুক্তিযুদ্ধে সাহায্য করতে গিয়ে ভারতের ১৯৮৪ জন সেনা সদস্য তাদের জীবন উৎসর্গ করেছিলেন।
১৯৭১ সালের ১৬ ডিসেম্বর। সাবেক পূর্ব পাকিস্তানের ছাত্র, আইনজীবী ও সাধারণ মানুষকে নিয়ে গড়া মুক্তিবাহিনী ও ভারতীয় সেনার যৌথ কমান্ডের কাছে আত্মসমর্পণ করতে বাধ্য হয় ৯৩ হাজার পাকিস্তানি সেনা। দু-সপ্তাহের যুদ্ধেই ৩০ লাখ বাঙালির গণহত্যাকারী পাক-সেনা আত্মসমর্পণে বাধ্য হয়। জন্ম নেয় গণপ্রজাতন্ত্রী স্বাধীন বাংলাদেশ। আর এই ঘটনার তিন মাসের মধ্যেই বাংলাদেশ ছেড়ে নিজেদের দেশে ফিরে যায় ভারতীয় সেনা। ভারত বুঝিয়ে দেয়, দখলদারির জন্য নয়, প্রতিবেশীর বিপদে পাশে দাঁড়ানোর লক্ষ্যেই তারা সেদিন সেনা পাঠাতে বাধ্য হয়েছিল। পাকিস্তানি অত্যাচারের হাত থেকে নিরীহ মানুষদের রক্ষা করতে সেদিন সর্বতোভাবে মুক্তিবাহিনীকে সাহায্য করলেও স্বাধীন বাংলাদেশ বিভিন্ন ঘাত-প্রতিঘাতের মধ্যে প্রতিরক্ষা ক্ষেত্রে বহুকাল ভারতের সঙ্গে সুসম্পর্ক গড়ে তুলতে ব্যর্থ হয়েছে। কিন্তু বর্তমানে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার বলিষ্ঠ নেতৃত্বে উভয় দেশের সামরিক সম্পর্কও উন্নতি হচ্ছে।
গত বছর বিজয় দিবসের অনুষ্ঠানে ঢাকায় ভারতীয় সেনা ও এনসিসি-র একটি দল প্যারেডে অংশ নেয়। তারপর এ বছর ২৬ জানুয়ারি বাংলাদেশেরও সামরিক প্রতিনিধিরা অংশ নিলেন দিল্লির প্যারেডে। বন্ধুত্ব সুদৃঢ় হলো। মুক্তিযুদ্ধে অবদানের জন্য এর আগে অবশ্য ভারতের বহু সেনাকর্তাকে সম্মানিত করেছে বাংলাদেশ। মুক্তিযুদ্ধে বিশেষ অবদানের জন্য সংবর্ধিতদের মধ্যে রয়েছেন প্রয়াত লে. জেনারেল জেএস অরোরা ও লে. জেনারেল জে এফ আর জ্যাকব প্রমুখ।
২০১৭ সালের এপ্রিল মাসে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার চার দিনের নতুন দিল্লি সফরকালে দুটি প্রতিরক্ষা সংক্রান্ত চুক্তি স্বাক্ষর করে দুই বন্ধু দেশ। প্রতিবেশী কোনও দেশের সঙ্গে ভারতের এ ধরনের চুক্তি আর নেই। এই চুক্তিবলে ভারত ও বাংলাদেশ প্রতিরক্ষা ক্ষেত্রে যৌথ মহড়া ও প্রশিক্ষণে সম্মত হয়। ভারতীয় থিঙ্ক ট্যাঙ্ক ‘অবজারভার রিসার্চ ফাউন্ডেশন’ (ওআরএফ)-এর মতে, দু-দেশের মধ্যে সামরিক সহযোগিতা বাড়ানোই ছিল এই চুক্তির উদ্দেশ্য।
ওআরএফের প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, ‘২০১৭ সালে বাংলাদেশি প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার ভারত সফরের আগে দু-দেশের মধ্যে সামরিক কোনও সমঝোতাই ছিল না। দীর্ঘস্থায়ী বন্ধুত্বের ক্ষেত্রে ভবিষ্যতে সমস্যা হতেই পারতো। প্রতিরক্ষা সমঝোতার কারণে সার্বিক সম্পর্কের স্থায়ীত্ব নিয়েও সংশয় থাকাটাই ছিল স্বাভাবিক। বাংলাদেশের স্বাধীনতার জন্য ভারতীয় সেনা প্রাণ দিলেও ১৯৭১-এর পরবর্তীতে সেই সম্পর্কও হোঁচট খায়। মুক্তিযুদ্ধে ভারতের আত্মত্যাগকে ভুলিয়ে দেওয়ার প্রক্রিয়াও চলছিল।’ সেইসঙ্গে প্রতিবেদনে স্মরণ করিয়ে দেওয়া হয়, ‘ভারতীয় সেনার সক্রিয় অংশগ্রহণে দেশে স্বাধীন হলেও এক সময়ে ভারত বিরোধিতার জন্য ব্যবহৃত হতে থাকে বাংলাদেশের মাটি। ভারতের নাশকতা করার জন্য পাকিস্তানের মদতপুষ্ট জঙ্গিরা ঘাঁটি গেড়ে বসে। ভারতবিরোধী বিভিন্ন জঙ্গি সংগঠনের স্বর্গরাজ্য হয়ে উঠেছিল বাংলাদেশ। জঙ্গিদলগুলির বিরুদ্ধে কোনও ব্যবস্থাই নেয়নি আগের সরকারগুলি। বরং ভারতীয় জঙ্গিরা জামাই আদর পেয়েছে বিভিন্ন সময়ে।
২০০৯ সালে শেখ হাসিনা প্রধানমন্ত্রীর দায়িত্ব নিয়েই কড়া হাতে দমন করতে শুরু করেন জঙ্গিদের। তার আমলেই সংযুক্ত মুক্তি বাহিনী, অসম (উলফা)-এর চেয়ারম্যান অরবিন্দ রাজখোঁয়া ও ন্যাশনাল ডেমোক্রাটিক ফ্রন্ট অফ বড়োল্যান্ড-এর রঞ্জন দৈমারি-সহ কট্টর জঙ্গিদের গ্রেফতার করে বাংলাদেশ সুসম্পর্ক গড়ার বার্তা দেয়। উন্নতি হতে শুরু করে দ্বিপাক্ষিক সম্পর্ক।’
এখানেই শেষ নয়। প্রতিরক্ষা সংক্রান্ত গবেষণা সংস্থা ওআরএফ স্বীকার করেছে, ভারত ও বাংলাদেশের মধ্যে এখন উন্নততর সম্পর্ক বিরাজ করছে। বলা হয়েছে, ‘অর্থনৈতিক, সামাজিক, বৈজ্ঞানিক ও প্রযুক্তি-সহ বিভিন্ন ক্ষেত্রে উভয় দেশই একে অন্যের সহযোগী হিসেবে পাশে দাঁড়াচ্ছে। ২০১৪ সালে নৌ সীমানা নিয়ে বিবাদ মিটিয়ে ফেলতে সক্ষম হয় দুই দেশ। এরপরে ভূমি সীমান্ত সমস্যাও মিটে যায়। ২০০৮ সালে বাংলাদেশের সেনা প্রধান জেনারেল মঈন আহমেদের ভারত সফরের পর থেকেই বাড়তে থাকে সামরিক ক্ষেত্রেও বন্ধুত্ব। এখন তো উভয় দেশেরই সেনা প্রধানরা নিয়মিত শুভেচ্ছা সফর করছেন। দু’দেশের রাষ্ট্রপতিই হচ্ছেন সেনা বাহিনীর সর্বোচ্চ পদাধিকারী। তাদেরও সফর হচ্ছে। ২০১৩ সালে ভারতের তখনকার রাষ্ট্রপতি প্রণব মুখার্জি বাংলাদেশ সফরে আসেন। তার এক বছর পরই বাংলাদেশের রাষ্ট্রপতি আবদুল হামিদও ভারত সফর করেন। সামরিক কর্তারাও নিয়মিত আলোচনার মাধ্যমে দ্বিপাক্ষিক বহু সংশয় দূর করতে সক্ষম হচ্ছেন। সামরিক্ষ ক্ষেত্রেও দু’দেশই এখন প্রকৃত বন্ধু।’
উভয় দেশের মধ্যে এখন নিয়মিত যৌথ মহড়া হচ্ছে। প্রশিক্ষণ ও চিকিৎসা সহায়তা নিয়েও চলছে যৌথ উদ্যোগ। উভয় দেশের যৌথ মহড়া ‘সম্প্রীতি’ ইতোমধ্যেই সাত বার অনুষ্ঠিত হয়। সপ্তম বার ভারতের মিজোরাম রাজ্যে অবস্থিত জঙ্গল ওয়ারফেয়ার স্কুল ভ্যারেন্টিতে ২০১৭ সালের নভেম্বরে অনুষ্ঠিত হয়। জঙ্গি দমন অভিযান ছিল এই প্রশিক্ষণের অঙ্গ। সবমিলিয়ে ভারত ও বাংলাদেশের মধ্যে এখন খুবই মধুর সম্পর্ক বিরাজ করছে। তবে প্রতিরক্ষা বিশেষজ্ঞদের মতে, বাংলাদেশে সরকার পরিবর্তন হলে পরিস্থিতির ফের অবনতি হতে পারে। তাই প্রাতিষ্ঠানিক আনুষ্ঠিকতার প্রয়োজনের কথা বলেন তারা দীর্ঘস্থায়ী বন্ধুত্বের স্বার্থে। প্রতিরক্ষায় সহযোগিতার ক্ষেত্রে উভয় দেশকেই আগামী দিনের দিকে তাকিয়ে চুক্তিবদ্ধ হওয়ার বিষয়টিকেই গুরুত্ব দিচ্ছেন কূটনৈতিক ও সামরিক বিশেষজ্ঞরা। বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের সময় চীন ছিল পাকিস্তানের পক্ষে। বাংলাদেশের সঙ্গে পূর্বতন সরকারের আমলে সামরিক সম্পর্ক স্থাপিত হলেও চীন কিন্তু বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের বিরোধী শক্তি ছিল। এমনকী, বাংলাদেশকে স্বীকৃতি দিতেও চায়নি তারা। জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের হত্যাকাণ্ডের পরই চীন বাংলাদেশের সঙ্গে কূটনৈতিক সম্পর্ক স্থাপন করে। সেইদিক থেকে দেখতে গেলে ভারত বাংলাদেশের প্রকৃত বন্ধু। কোনও স্বার্থ ছাড়াই মহান মুক্তিযুদ্ধের সময় আমাদের পাশে দাঁড়িয়েছিল। মহান স্বাধীনতা লাভের পরই ভারতীয় সেনারা ফিরে যায় নিজেদের দেশে। কখনও দখলদারি মনোভাব দেখায়নি। এমনকী, বন্ধুত্বের থেকে কখনওই বাণিজ্যিক স্বার্থকে বড় করে দেখে না ভারত। তাই সামরিক ক্ষেত্রে ভারতের সঙ্গে সুসম্পর্ককে দীর্ঘস্থায়ী রাখার পথ প্রশস্ত করতে হবে। উভয় দেশের স্থল, নৌ ও বিমান বাহিনীর নিয়মিত প্রশিক্ষণ ও মহড়া জরুরি। প্রয়োজন বন্ধুত্বপূর্ণ সহযোগিতার। উভয় দেশের সামরিক বিশেষজ্ঞদের মতবিনিময়ও জরুরি বলে মনে করেন বিশেষজ্ঞরা। সেনা কর্মকর্তারা নিয়মিত আলোচনার মাধ্যমে নিজেদের আরও সমৃদ্ধ করে তুলতে পারেন। নৌ সীমান্ত পাহাড়ায় প্রয়োজন যৌথ ও সমন্বিত টহলদারি। পরিকাঠামো উন্নয়নেও একে অন্যের আরও সহায়ক হয়ে উঠতে পারে।
বিশেষজ্ঞরা মনে করেন, উভয় দেশের প্রতিরক্ষা সচিবদের পাশাপাশি সেনা কর্মকর্তাদেরও নিয়মিত আলোচনায় বসা জরুরি। দ্বিপাক্ষিক যাবতীয় সমস্যা আলোচনার মাধ্যমে মিটিয়ে নিতে উভয় দেশ সক্ষম বলে তারা মনে করেন। ২৬ জানুয়ারি দিল্লিতে ভারতের প্রজাতন্ত্র দিবসে অংশ নিয়ে দেশের স্বাধীনতার সুবর্ণ জয়ন্তীতে যে বন্ধুত্বের বার্তা দিয়েছে বাংলাদেশের সশস্ত্র বাহিনী, সেই বার্তাকেই পাথেয় করে উভয় দেশের প্রতিরক্ষা সংক্রান্ত বন্ধুত্ব আরও এগিয়ে যাক। এমনটাই চাইছেন বিশেষজ্ঞরা।
(তথ্য সূত্র : বিডিমিলিটারিডটকম, ১৬ মার্চ, ২০১৭-র ‘বাংলাদেশ-ইন্ডিয়া মিলিয়াটির কোঅপারেশন ডিল এক্সপ্লেইনড’।)