আমাদের ‘ভ্যাকসিন হিরো’
1 min readকোভিডের দ্বিতীয় ধাক্কাটা আসি-আসি করতে-করতে শেষমেষ এসেই গেল। ইউরোপে তো ধাক্কাটা বেশ জোরেসোরেই লেগেছে। কোভিড বাড়ছে আমেরিকায় আর ঘরের পাশে ভারতেও। বাংলাদেশেও বাড়ার ইঙ্গিতগুলো স্পষ্ট। পাশাপাশি পাল্লা দিয়ে চলছে ভ্যাকসিন নিয়ে আলোচনা। একের পর এক প্রতিষ্ঠান ভ্যাকসিন নিয়ে তাদের গবেষণার ফলাফলগুলো প্রকাশ করছে। কোনটার সাফল্য নব্বই শতাংশ তো কোনটার পঁচানব্বই। এরই মধ্যে জানা গেছে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে ভ্যাকসিন দেওয়া শুরু হবে আসছে মাসের ১২ তারিখ থেকে। সঙ্গত কারণেই প্রশ্ন জাগছে, কবে বাংলাদেশে আমরা ভ্যাকসিন পেতে যাচ্ছি? শুধু তাই না- কোন্ ভ্যাকসিন, কোথাকার ভ্যাকসিন, কত দামে, আর কারা আগে পাবে এ নিয়েও আলোচনার শেষ নেই।
ভ্যাকসিন নিয়ে কথা চলছে অনেকদিন ধরেই, হচ্ছে এখনও। ভারত, মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র ও চীন এই তিনটি দেশই জি-টু-জি ভিত্তিতে তাদের ভ্যাকসিনে বাংলাদেশকে অগ্রাধিকার দেওয়ার কথা জানিয়েছে। আশা করা যাচ্ছে, এদের যে কারো ভ্যাকসিন অনুমোদন পেলেই আমরা তার ভাগ পাবো। আমাদের সরকার এরই মাঝে নাম লিখিয়েছেন কোভ্যাক্স-এ। সেখান থেকে পাওয়া যাবে ৬ কোটি ৮০ লাখ ডোজ ভ্যাকসিন। এ জন্য খরচ পড়বে প্রতি ডোজ দুই ডলারের মত। সমস্যা হচ্ছে, জনসংখ্যা অনুপাতে কোভ্যাক্সের কাছ থেকে এর বেশি ভ্যাকসিন পাওয়ার সুযোগ নেই বাংলাদেশের। আর পাশাপাশি সরকারকে গ্লোবাল অ্যালায়েন্স ফর ভ্যাকসিনস অ্যান্ড ইমিউনাইজেশন (গ্যাভি) এর কাছে জাতীয় ভ্যাকসিন বিতরণ পরিকল্পনা জমা দিতে হবে। সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তারা আশ্বস্ত করেছেন গ্যাভি বিভিন্ন দেশের কাছ থেকে তাদের জাতীয় পরিকল্পনাগুলো জমা নিতে শুরু করলে তারা প্রথম দিনই আমাদের জাতীয় পরিকল্পনাটি জমা দিয়ে দিবেন। এটি অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ কারণ যেসব দেশ তাদের পরিকল্পনা আগেভাগে জমা দিবে তাদেরকেই অগ্রাধিকার ভিত্তিতে ভ্যাকসিন দেওয়ার কথা গ্যাভি স্পষ্ট করে জানিয়ে দিয়েছে। সরকারিভাবে রাশিয়ার সাথে যোগাযোগের কথাও শোনা যাচ্ছে। ভ্যাকসিন আনার ক্ষেত্রে আরেকটি গুরুত্বপূর্ণ অগ্রগতি অর্জিত হয়েছে এ মাসের ৬ তারিখে।
ভারতের সেরাম ইন্সটিটিউটের তৈরি অক্সফোর্ডের ভ্যাকসিনটি দেশে আনার ব্যাপারে আনুষ্ঠানিক সমঝোতাটি এদিন স্বাক্ষরিত হয়েছে বাংলাদেশ সচিবালয়ে। সমঝোতাটি স্বাক্ষরের সময় উপস্থিত ছিলেন স্বাস্থ্যমন্ত্রীসহ প্রশাসনের উর্ধ্বতন কর্মকর্তারা আর ঢাকায় নিযুক্ত ভারতীয় হাইকমিশনার। মিডিয়া মারফত জানা যাচ্ছে সেরাম ইন্সটিটিউট অব ইন্ডিয়ার স্থানীয় প্রতিনিধি বেক্সিমকো ফার্মাসিউটিক্যালস আগামী জানুয়ারী মাস থেকে প্রতিমাসে ৫০ লাখ ডোজ করে মোট ৩ কোটি ডোজ ভ্যাকসিন সরকারের কাছে হস্তান্তর করবে। যেহেতু ২৮ দিনের ব্যবধানে দুই ডোজ ভ্যাকসিন নেওয়ার প্রয়োজন পড়বে, সেই হিসেবে দেড় কোটি মানুষ এ থেকে উপকৃত হবেন।
নানা কারণে এটি একটি গুরুত্বপূর্ণ অগ্রগতি। দেশের ওষুধ শিল্পের অন্যতম পুরোধা প্রতিষ্ঠান বেক্সিমকো ফার্মাসিউটিক্যালস আরো একবার অভিনন্দনের দাবিদার। করোনাকালে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে পিপিই রপ্তানি করে আর বাংলাদেশের বাজারে প্রথমবারের মত রেমডিসিভির নিয়ে আসার কৃতিত্ব তাদের। সেই তালিকায় এবার যুক্ত হলো দেশের মানুষের জন্য সবার আগে ভ্যাকসিন নিয়ে আসার বিষয়টিও। জানা যাচ্ছে ভারত এবং বাংলাদেশ, এই দুই দেশের সরকারই একই দাম, অর্থাৎ পাঁচ থেকে ছয় ডলারে প্রতি ডোজ ভ্যাকসিন পাবে। একই দাম নির্ধারণ করাটাও নিঃসন্দেহে প্রশংসনীয়। মাননীয় প্রধানমন্ত্রীর বেসরকারি শিল্প ও বিনিয়োগ উপদেষ্টা জনাব সালমান এফ রহমান জানিয়েছেন ভারত সরকার ভ্যাকসিনটি আরো কম দামে পেলে, সেই সুবিধা পাবে বাংলাদেশ সরকারও। পাশাপাশি জানা গেছে বেসরকারীভাবেও বেক্সিমকোর উদ্যোগে পাওয়া যাবে ভ্যাকসিনটি। ফলে বঞ্চিত হবেন না দেশের সাধারণ মানুষও।
সরকারিভাবে এ টিকা নেওয়ার সুযোগ পাবেন দেশের ফ্রন্টলাইনাররা। এ ব্যাপারে একটি নীতিমালা প্রণয়নের কাজ চলছে। ভ্যাকসিন পাওয়ায় অগ্রাধিকার পাবেন সকল ধরনের স্বাস্থ্যকর্মী- ডাক্তার, নার্স, টেকনিশিয়ান, ওয়ার্ডবয় সবাই। দ্বিতীয় ধাপের ভ্যাকসিন পাবেন দেশের ২০ লাখ ষাটোর্দ্ধ নাগরিক আর তার পর পুলিশ, প্রশাসন ও সামরিক বাহিনীর সদস্যরা। আপাতত ১৮ বছরের নিচে কাউকে ভ্যাকসিন না দেওয়ার সিদ্ধান্ত নিচ্ছে সরকার। দেশে বর্তমানে টিকা সংরক্ষণ ও সরবরাহ করার যে অবকাঠামো রয়েছে সেটিই কোভিড ভ্যাকসিন সংরক্ষণ ও বিতরণে ব্যবহার করা হবে। প্রাথমিকভাবে টিকাগুলো সংরক্ষণ করা হবে দেশের কেন্দ্রিয় ঔষাধাগার বা সিএমএসডি-তে। সেখান থেকে চাহিদা অনুযায়ী পাঠানো হবে আঞ্চলিক টিকা সংরক্ষণ কেন্দ্রে। সেগুলো থেকে বিভাগীয়, জেলা ও উপজেলার হাসপাতালগুলোতে। প্রশিক্ষণপ্রাপ্ত স্বাস্থ্যকর্মীরা এগুলো বিতরণের ব্যবস্থা করবেন। দেশের কোল্ডচেইন অবকাঠামো আরো মজবুত করা আর ভ্যাকসিনের সুষ্ঠু সরবরাহ নিশ্চিত করায় ইতিমধ্যে একাধিক প্রকল্প নেওয়ার কথাও জানা গেছে।
তবে সবচেয়ে যা গুরুত্বপূর্ণ তা হলো, এরই মধ্যে ৩ কোটি টিকার মোট দামের অর্ধেক প্রায় সাড়ে ছয়শ কোটি টাকা সেরাম ইন্সটিটিউট অব ইন্ডিয়াকে পরিশোধ করার জন্য অর্থ ছাড় করেছে অর্থ মন্ত্রণালয়। মুজিববর্ষের বিশেষ অধিবেশনে জাতীয় সংসদে দাঁড়িয়ে মাননীয় প্রধানমন্ত্রী এ ঘোষণাটি দিয়েছেন। এ অর্থের জন্য কারো মুখাপেক্ষী হতে হয়নি বাংলাদেশকে। নিজের রিজার্ভ থেকেই নিজের মানুষের জন্য ভ্যাকসিনের ব্যবস্থা করছেন আমাদের মাননীয় প্রধানমন্ত্রী।
দেশে সবার আগে যে আসতে যাচ্ছে অক্সফোর্ড ভ্যাকসিন এটি এখন মোটামুটিভাবে নিশ্চিত। এই ভ্যাকসিনটি নানা কারণেই ব্যক্তিগতভাবে আমার পছন্দের তালিকায় উপরের দিকে। প্রথম কারণটি অবশ্যই ‘অক্সফোর্ড’। বিশ্বে জ্ঞান-বিজ্ঞান চর্চার মাপকাঠি এ বিশ্ববিদ্যালয়টি। একসময় যখন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় উৎকর্ষের শীর্ষে পৌঁছেছিল, তখন তাকে ‘প্রাচ্যের অক্সফোর্ড’-ই বলা হতো। এ ভ্যাকসিন ট্রায়ালের ব্যাপারেও অক্সফোর্ডের সতর্কতার জায়গাটি আমরা দেখেছি। ট্রায়ালে অংশ নেওয়া একজন ভলান্টিয়ারের সাইড এফেক্ট দেখা দিলে বন্ধ করে দেওয়া হয়েছিল পুরো ট্রায়ালটি। পরে জানা যায় তিনি সুস্থ রয়েছেন। ব্রিটিশ নিয়ন্ত্রণকারী কর্তৃপক্ষের অনুমোদনে ট্রায়ালটি পরে আবার শুরু হয়। কাজেই ভ্যাকসিনটি যে নিরাপদ আর অক্সফোর্ডও যে সতর্কতায় কোনও ঘাটতি রাখছে না তা বলা যেতেই পারে।
ভ্যাকসিনটি দামেও কম। ফাইজার আর মডার্নার ভ্যাকসিনের দাম যেখানে পরবে ২৫-৩৭ মার্কিন ডলার, সেখানে অক্সফোর্ডের ভ্যাকসিনের দাম ৫ ডলারের মত, যা এমনকি ৭ ডলার দামের চীনা ভ্যাকসিনের চেয়েও সস্তা।
পাশাপাশি ভ্যাকসিনটির উৎপাদক প্রতিষ্ঠান সেরাম ইন্সটিটিউট অব ইন্ডিয়া শুধু ভারতেরই নয়, এটি বিশ্বেরও বৃহত্তম ভ্যাকসিন প্রস্তুতকারক প্রতিষ্ঠান। বছরে তারা ১৫০ কোটি ডোজ ভ্যাকসিন তৈরির সক্ষমতা রাখে। আর বাংলাদেশসহ সারা পৃথিবীর ১৭০টি দেশের ইপিআই প্রোগ্রামে যেসব ভ্যাকসিন ব্যবহার করা হয় তার বেশিরভাগটাই আসে এখান থেকে। আসারই কথা, কারণ বর্তমান বিশ্বে ব্যবহৃত টিকার দুই তৃতীয়াংশ ভ্যাকসিন উৎপাদন করে সেরাম ইন্সটিটিউট অব ইন্ডিয়া। ভ্যাকসিন গবেষণায় ১৯৬৬ সালে প্রতিষ্ঠিত এই প্রতিষ্ঠানটির রয়েছে দীর্ঘ ঐতিহ্য। র্যাবিশিল্ড নামের এন্টি-র্যাবিস হিউম্যান মনোক্লোনাল অ্যান্টিবডি সেরাম ইন্সটিটিউট অব ইন্ডিয়া এবং মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের ম্যাসাচুসেট্স মেডিকেল স্কুল যৌথভাবে উদ্ভাবন করে। এছাড়াও তারা একটা ইন্ট্রান্যাজাল সোয়াইন ফ্লু ভ্যাকসিন নিয়েও গবেষণা করছে। প্রতিষ্ঠানটি দশ কোটি ডোজ অক্সফোর্ড ভ্যাকসিন তৈরির জন্য চুক্তিবদ্ধ। ইউএস এফডিএ অনুমোদিত পুনের এই প্রতিষ্ঠানটি ২০১২ সালে নেদারল্যান্ডস এর বিখ্যাত বেটোফেন বায়োলজিক্যালস অধিগ্রহণ করে।
এখন পর্যন্ত ভ্যাকসিন নিয়ে আমদের প্রস্তুতির যে অগ্রগতি তা অবশ্যই আশাব্যঞ্জক। আর ভ্যাকসিন নিয়ে আমাদের সাফল্যও নতুন কোনও বিষয় নয়। ২০১৯- এ গ্যাভি, মাননীয় প্রধানমন্ত্রীকে ‘ভ্যাকসিন হিরো’ পদকে ভূষিত করেছিল। প্রধানমন্ত্রীর হাতে পদকটি তুলে দিতে গিয়ে গ্যাভি-র সিইও ড. সেথ বার্কলে বলেছিলেন, “শেখ হাসিনা ভ্যাকসিনেশনের সত্যিকারের চ্যাম্পিয়ন’।
আর অতদুরেই বা যাই কেন, লিভার বিশেষজ্ঞ হিসেবে আমি নিজেইতো জানি, মাননীয় প্রধানমন্ত্রীর তত্তাবধানে আমাদের সফল ইপিআই কর্মসূচির মাধ্যমে আমরা গত বছরই হেপাটাইটিস বি ভাইরাস নির্মূলের এডিজি টার্গেটের প্রাথমিক মাইলফলকটি অর্জন করেছি। দেশের পাঁচ বছরের কম বয়সী শিশুদের মধ্যে হেপাটাইটিস বি’র প্রার্দুভাব এখন এক শতাংশের নিচে, যার স্বীকৃতি দিয়েছে বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা গতবছর। সংস্থাটির দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার অ লের হেপাটাইটিস বি ও সি ভাইরাস সংক্রান্ত স্ট্র্যাটেজিক অ্যান্ড টেকনিক্যাল অ্যাডভাইজারি গ্রুপের সদস্য হিসেবে আমি দেখেছি সংস্থাটি এ জন্য মাননীয় প্রধানমন্ত্রীকে কিভাবে মূল্যায়ন করে। যে এক হাজার একটা কারণের জন্য বাঙালি জাতি শেখ হাসিনার কাছে চিরকৃতজ্ঞ থাকবে, সেই তালিকায় মাত্রই যুক্ত হলো আরো একটি বিষয়- ‘ধন্যবাদ ভ্যাকসিন হিরো’!
লেখকঃ মামুন আল মাহতাব, বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিক্যাল বিশ্ববিদ্যালয়ের লিভার বিভাগের চেয়ারম্যান এবং সম্প্রীতি বাংলাদেশ- এর সদস্য সচিব