স্ট্রোক হয়েছে বুঝবেন যেভাবে
1 min readস্ট্রোক মস্তিষ্কের রক্তনালীর মারাত্মক রোগ। এই রোগে আক্রান্ত হওয়া মানেই মৃত্যুবরণ করা কিংবা আমৃত্যু পঙ্গু হয়ে পরিবার ও সমাজের হয়ে বোঝা হয়ে বেঁচে থাকা– কথাটি হয়তো কয়েক বছর আগেও সত্যি ছিল।
প্রাথমিক স্বাস্থ্যসেবা ও সংক্রামক রোগ চিকিৎসায় উদ্ভাবনে বাংলাদেশ বিশ্বে দৃষ্টান্ত স্থাপন করার পাশাপাশি জটিল, অ্যাকিউট ও ক্রোনিক নন কমিউনিকেবল রোগসমূহের উন্নত চিকিৎসা নিশ্চিতকরণে মাননীয় প্রধাণমন্ত্রী শেখ হাসিনার যুগোপযোগী নেতৃত্বে গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ সরকার গুরুত্বারোপ করছে।
২০২০ সালে করোনা মহামারী মোকাবেলার পাশাপাশি, ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে নিউরোসার্জারি বিভাগের অধীনে অত্যাধুনিক নিউরো-ক্যাথল্যাব স্থাপন করা হয়েছে যেখানে স্ট্রোক সহ মস্তিষ্ক ও মেরুদণ্ডের গুরুতর রক্তনালির রোগসমূহের ডায়াগনোসিস ও চিকিৎসা প্রদান করা সম্ভব।
স্ট্রোক কী?
মস্তিষ্কের রক্তনালি বাধাপ্রাপ্ত হলে কিংবা ছিড়ে রক্তক্ষরণ হলে স্নায়ুকোষে রক্ত চলাচল ব্যাহত হয়। এটিই স্ট্রোক বা ব্রেইন অ্যাটাক!
রক্তনালিতে চর্বি বা থ্রম্বাস জমে সরু হয়ে যে স্ট্রোক হয় সেটি ইসকেমিক স্ট্রোক । আর রক্তনালি ফেটে রক্তক্ষরণ হলে সেটাকে হেমোরেজিক স্ট্রোক বলে। দ্বিতীয়টির মৃত্যু ঝুঁকি বেশি হলেও আমেরিকান স্ট্রোক অ্যাসোসিয়েশন এর জরিপ অনুযায়ী, ৮৭ ভাগ স্ট্রোকই ইসকেমিক ধরনের হয়ে থাকে। তাৎক্ষণিক চিকিৎসার অভাবে দীর্ঘমেয়াদি পঙ্গুত্বের বিশ্বব্যাপী প্রধান কারণ- স্ট্রোক!
এছাড়াও ট্রান্সিয়েন্ট ইসকেমিক স্ট্রোক (TIA) বা ওয়ার্নিং স্ট্রোক নামে কিছুক্ষণ বা ২৪ ঘন্টার কম সময়ের জন্য রোগি স্ট্রোকের মত উপসর্গে ভুগে যেটা মাইল্ড স্ট্রোক নামে পরিচিত। যথাযথ চিকিৎসা না নিলে এদের ১০ জনে ১ জন ৩ মাসের মধ্যে মেজর স্ট্রোকে আক্রান্ত হয়।
হার্ট অ্যাটাক বা হৃদরোগ মৃত্যুর প্রধান কারণ হলেও স্ট্রোকের মৃত্যুহার রোগ হিসেবে দ্বিতীয় সর্বোচ্চ এবং সামগ্রিক জীবনমান ও আর্থসামাজিক ক্ষতি অপরিমেয়। ওয়ার্ল্ড স্ট্রোক অর্গানাইজেশন এর পরিসংখ্যান অনুযায়ী – প্রতি ১ মিনিটে ১০ জন মানুষ স্ট্রোকে আক্রান্ত হন। তাদের ২০ শতাংশের বয়স ৪০ বছরের নিচে। প্রতি ৪ জনের মধ্যে ১ জন জীবদ্দশায় স্ট্রোকে আক্রান্ত হবেন।
(তথ্য সূত্রঃ WHO & WSO)
আপনিই সেই একজন নন তো?
অনিয়ন্ত্রিত জীবনযাপন, ধুমপান, উচ্চরক্তচাপ, ডায়াবেটিস, ৫৫ বছরের বেশি বয়স্কদের ব্রেন স্ট্রোকের ঝুঁকি বেশি। তবে শিশু থেকে শুরু করে যে কেউ এ রোগে আক্রান্ত হতে পারেন।
এছাড়া সম্প্রতি গবেষণায় মহিলাদের স্ট্রোক হওয়ার হার বেশি পরিলক্ষিত হয়। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা (WHO) এর মতে ৯০ ভাগ স্ট্রোকই অনিয়ন্ত্রিত ও ঝুঁকি পূর্ণ জীবনযাপনের সাথে ওতপ্রোতভাবে জড়িত। অথচ ১০ টি অভ্যাস পরিবর্তন করে স্বাস্থকর জীবন যাপন করলে স্ট্রোক থেকে আপনি নিজেকে রক্ষা করতে পারেন।
কিভাবে বুঝবেন স্ট্রোক হয়েছে?
যদি আচমকা হাত, পা, বা শরীরের কোনো এক দিক অবশ লাগে বা চোখে দেখতে বা কথা বলতে অসুবিধা হয়, কিংবা তীব্র মাথা ব্যাথা হয় ও হঠাৎ ভারসাম্য হারিয়ে পড়ে যান – এমন কোনো একটি লক্ষণ দেখার সাথে সাথে দ্রুত হাসপাতালে চিকিৎসক এর শরণাপন্ন হোন। এগুলো BE FAST ( Balance, Eye, Face, Arm, Speech & Time) হিসেবে পরিচিত।
হাসপাতালে প্রাথমিক চিকিৎসা- শ্বাসপ্রশ্বাস ও রক্ত সন্ঞ্চালন নিশ্চিত করার পর দ্রুত মাথার সিটি স্ক্যান করে স্ট্রোকের ধরণ নির্ণয় করবেন চিকিৎসক গণ। রোগীর সজনদের উচিৎ এসময় রোগিকে মুখে কিছু না খাওয়ানোর চেষ্টা করা এবং এক দিকে কাত করে, বালিশ ছাড়া মাথা নিচু করে শোয়াতে হবে। ঔষধ ও পথ্য নিশ্চিতকরণে প্রয়োজনে নাকে নল দিতে হতে পারে।
তাৎক্ষণিক চিকিৎসার সুবর্ণ সময়
সিটি স্ক্যানে ইসকেমিক স্ট্রোক নির্ণয় হলে এন্টিপ্লেটলেট ও এন্টিকোয়াগুলেন্ট ঔষধ এর পাশাপাশি সম্প্রতি “অ্যালটিপ্লেজ” নামক থ্রোম্বোলাইটিক থেরাপি যা দ্রুত জমাট বাধা রক্ত গলিয়ে দেয় – প্রয়োগের মাধ্যমে সাড়ে চার ঘন্টা পর্যন্ত মস্তিষ্কের দীর্ঘমেয়াদি ক্ষতি বা প্যারালাইসিস রোধ করা সম্ভব।
এটি স্ট্রোক চিকিৎসার গোল্ডেন আওয়ার বা সুবর্ণ ঘন্টা নামে জনপ্রিয়। পরবর্তীতে এমআরআই ইমেজ এর ওপর ভিত্তি করে ৬-১৬ ঘন্টা পর্যন্ত সময়ে এন্ডোভাস্কুলার নিউরোসার্জনগন না কেটে সরু নলের সহায়তায় জমাট বাধা রক্ত বা চর্বির দলা বের করে আনতে পারেন। এছাড়াও গলায় অবস্থিত ক্যারোটিড ধমনী বেশি সংকুচিত হয়ে গেলে রিট্রাইভার মেশিনের সহায়তায় স্টেনটিং ও বেলুন এনজিওপ্লাস্টি করে মস্তিষ্কের রক্তসঞ্চালন পুনরায় ফিরিয়ে দিতে সক্ষম। উন্নত বিশ্বে প্রায় ২৪ ঘন্টা পর্যন্ত মেকানিকাল থ্রম্বেক্টমির চেষ্টা করা হয়- যা এখন ঢাকাতেই সম্ভব। কিন্তু খেয়াল রাখতে হবে টাইম ইজ ব্রেইন- স্ট্রোকের পর প্রতি মিনিটে ২ মিলিয়ন স্নায়ু কোষ চিরতরে মারা যায়।
হেমরেজিক বা রক্তক্ষরণজনিত স্ট্রোক হলে থ্রোম্বোলাইটিক
ঔষধ প্রয়োগে আরও বিপত্তি হবে। রক্তক্ষরণের কারণ নির্ণয় করে -এন্ডোভাস্কুলার নিউরোসার্জনদের দক্ষ টিম এনিউরিজম(রক্তনালির ফোস্কা) ক্লিপিং ও কয়েলিং করতে পারেন। ক্ষেত্র বিশেষে শিশু ও কিশোরদের বিরল রক্তনালির জন্মগত ত্রুটিপূর্ণ গঠন দেখা দিলে তা স্ট্রোকের মত উপসর্গ হিসেবে দেখা দেয়।
এসব জটিল ক্ষেত্রে একই সংগে ক্যাথল্যাব এ এন্ডোভাস্কুলার অ্যাপ্রোচের সাহায্যে নিয়ন্ত্রণ করে পরে মাথার খুলি হাইস্পিড ড্রিলের মাধ্যমে কেটে বিকৃত রক্তনালি সম্পূর্ণরূপে অপসারণ সম্ভব। নতুন এই দ্বৈত শল্যচিকিৎসা পদ্ধতিকে হাইব্রিড পদ্ধতি বলা হয়। বাংলাদেশে ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের নিউসার্জারি বিভাগে এই সেবা সম্প্রতি চালু হয়েছে।
তাৎক্ষণিক চিকিৎসার প্রধান উদ্দেশ্য মৃত্যুঝুঁকি কমানোর পাশাপাশি কর্মক্ষমতা ফিরিয়ে আনা এবং পরবর্তী স্ট্রোকের ঝুকি হ্রাস করা৷সময় মতো যথাযথ চিকিৎসা পেলে শতকরা ৩০ ভাগ রোগী সম্পূর্ণ সুস্থ হয়ে কর্মময় জীবনযাপনে ফিরে যেতে পারবেন। অনেকের স্ট্রোক পরবর্তী পুনর্বাসন প্রোগ্রাম পালন করতে হতে পারে।