করোনা সংক্রমনে শয্যাশূন্য প্রায় প্রতিটি হাসপাতাল, এম্বুলেন্সের দীর্ঘ সারি
1 min readপঞ্চান্ন বছর বয়সী আলাল মিয়া। চাঁদপুরের এই ক্ষুদ্র ব্যবসায়ী গত শুক্রবার থেকে কাশি, বুকব্যথা ও শ্বাসকষ্টে ভুগছিলেন। স্থানীয় চিকিৎসকের কাছ থেকে প্রাথমিক চিকিৎসা নিয়ে দু’দিন ভালোই কেটেছে তার। সোমবার রাত থেকে তার শারীরিক অবস্থার অবনতি হতে থাকে। উপায়ন্তর না পেয়ে স্বজনরা তাকে মঙ্গলবার সকাল ৬টায় নিয়ে আসেন ঢাকার বক্ষব্যাধি হাসপাতালে। সেখানকার চিকিৎসকরা ঠিকমতো পরীক্ষা-নীরিক্ষা না করেই করোনা পরীক্ষার রিপোর্ট নিয়ে আসতে বলেন। স্বজনরা তখন কয়েকটি করোনা পরীক্ষা কেন্দ্রে ঘুরে পরীক্ষা করানোর ব্যবস্থা করতে পারেননি। এছাড়া তাৎক্ষণিক রিপোর্ট পাওয়ারও কোনো ব্যবস্থা নাই।
তারপর থেকে আলাল মিয়াকে নিয়ে এম্বুলেন্সে করে এক হাসপাতাল থেকে আরেক হাসপাতালে ঘুরতে থাকেন স্বজনরা। সকাল ৬টা থেকে বিকাল চারটা পর্যন্ত মোট ১০ ঘণ্টায় সাত হাসপাতাল ঘুরেও আলাল মিয়াকে কোথাও ভর্তি করা যায়নি। সর্বশেষ ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালও সিট সংকটের জন্য তাকে ভর্তি নেয়নি।
বিকাল তিনটার দিকে ঢামেক হাসপাতালের সামনে এম্বুলেন্সে বসে আলাল মিয়ার স্ত্রী মনোয়ারা বেগম বলেন, ভোরবেলা চাঁদপুর সদর হাসপাতালে গিয়েছিলাম। সেখান থেকে ঢাকার বক্ষব্যাধি হাসপাতালে আনার পরামর্শ দেয়া হয়। তাদের কথামতোই বক্ষব্যাধি হাসপাতালে নিয়ে আসি। করোনা পরীক্ষার রিপোর্ট না থাকায় সেখানে ভর্তি নেয়নি। হাসপাতাল থেকে বলা হয় আমার স্বামীর করোনার উপসর্গ আছে। তাই করোনা ডেডিকেটেড হাসপাতালে ভর্তি করাতে হবে। তারপর এক আত্মীয়ের পরামর্শে নিয়ে যাই মুগদা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে। সেখানে ভর্তি করাতে পারি নাই। তারপর একে একে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয় হাসপাতাল, বাংলাদেশ স্পেশালাইজড, কুর্মিটোলা জেনারেল হাসপাতাল, শেখ রাসেল গ্যাস্ট্রোলিভার হাসপাতাল ঘুরেছি। সর্বশেষ ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে নিয়ে এসেছি। এখানে এসেও শুনি কোনো সিট খালি নাই। একজন এসে অক্সিজেন মেপে বলেছেন অবস্থা অতটা ভালো না। তাই জরুরি ভিত্তিতে চিকিৎসা শুরু করতে হবে। তিনি বলেন, সব হাসপাতালেই অনেক কাকুতি-মিনতি করেছি। এখন এই রোগীকে নিয়ে কোথায় যাবো কি করবো বুঝতেছি না। এখন একমাত্র ভরসা কোনো বেসরকারি হাসপাতালে যদি ভর্তি নেয়।
শুধু আলাল মিয়াই নন, করোনা সংক্রমণ বেড়ে যাওয়াতে জটিল রোগীদের সংখ্যা বাড়ছেই। শয্যাশূন্য ঢাকার প্রায় প্রতিটি হাসপাতাল। বেসরকারি কয়েকটি হাসপাতাল একই কাতারে গিয়ে পৌঁছেছে। শয্যা সংকট থাকায় রোগীরা হাসপাতালে হাসপাতালে ঘুরছেন। সরজমিন গতকাল ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে গিয়ে দেখা গেছে, এম্বুলেন্সের দীর্ঘ সারি। দেশের বিভিন্ন প্রান্ত থেকে একটু পর পর আসছে এম্বুলেন্স। দুপুরের দিকে মাত্র ৪৫ মিনিটে ১৭টি এম্বুলেন্সে করে সতেরো জন রোগী এসেছেন। এদের অধিকাংশ মুমূর্ষু। বেশকিছু রোগীর সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, অনেক রোগী করোনা পজিটিভ বা কোনো উপসর্গ নাই। এরপরেও তারা কোনো হাসপাতালে ভর্তি হতে পারছেন না। প্রতিটি হাসপাতাল থেকে বলা হচ্ছে করোনা পরীক্ষা করানো আছে কিনা। এছাড়া সব হাসপাতালেই সিট না থাকার কথা বলা হচ্ছে।
তিনদিন আগে করোনা পজিটিভ হয়েছেন রাবেয়া আক্তার। বয়স ৫০ ছুঁই ছুঁই এই রোগীর শ্বাসকষ্ট দেখা দিয়েছে গতকাল সকাল থেকে। অবস্থা সংকটাপন্ন হওয়াতে রাবেয়ার তিন ছেলে তাকে কুমিল্লা থেকে নিয়ে আসেন ঢাকায়। ঢামেক হাসপাতালে এই নারীর মেজো ছেলে আরিফ হোসেন বলেন, অক্সিজেন লেভেল স্বাভাবিক মাত্রার চেয়ে অনেক নিচে নেমেছে। সকালে প্রথমে কুর্মিটোলা হাসপাতালে নিয়ে যাই। সেখানকার কর্তব্যরতরা জানিয়েছেন শয্যার চেয়ে অতিরিক্ত ভর্তি। তাই রোগী ভর্তি হবে না। তারপর শেখ রাসেল গ্যাস্ট্রোলিভার হাসপাতাল, মুগদা মেডিকেল হাসপাতাল হয়ে ঢামেকে এসেছি। এই হাসপাতালের জরুরি বিভাগের সামনে প্রায় দুই ঘণ্টা ধরে অপেক্ষা করছি অথচ কোনো সিটের ব্যবস্থা করতে পারছি না। এখন অপেক্ষায় আছি যদি কোনো সিট খালি হয় তবে সেখানেই ভর্তি করাবো।
মুগদা জেনারেল হাসপাতালের সামনে এক রোগীর স্বজন সাব্বির রশিদ বলেন, আবার বাবা মোতায়ের হোসেন কাঠ ব্যবসায়ী। কয়েকদিন ধরেই তার করোনা উপসর্গ ছিল। পরে করোনা পরীক্ষা করালে পজিটিভ রেজাল্ট আসে। মঙ্গলবার রাত থেকেই শ্বাসকষ্ট শুরু হয়েছে। এলাকায় অক্সিজেন সাপোর্ট দেয়ার মতো কোনো সুযোগ নাই। তাই তাকে নিয়ে ঢাকায় আসছি। সকাল থেকে ঢাকার বিভিন্ন হাসপাতালে ঘুরেছি। কোনো হাসপাতালেই তাকে ভর্তি নিচ্ছে না। ভর্তি না করলে চিকিৎসা শুরু করা যাবে না। তিনি বলেন, হাসপাতালের এমন অবস্থা শুধু তারাই বুঝবে।