December 12, 2024

ফরচুন নিউজ ২৪

উন্নয়নের অগ্রযাত্রায় বরিশাল বিসিক শিল্প নগরী

1 min read

অযত্ন অবহেলায় পড়ে থাকা দেশের অন্যতম বৃহৎ আয়তনের শিল্প নগরী বরিশাল বিসিকের উন্নয়নকাজে গতি ফিরেছে। এতে স্বস্তি ফিরেছে শিল্প মালিকদের মাঝে।

বরিশাল ক্ষুদ্র ও কুটির শিল্প কর্পোরেশন (বিসিক) প্রতিষ্ঠার প্রায় ৩২ বছর নানা চড়াই-উৎড়াই পেরিয়ে অবশেষে শিল্প নগরীতে উন্নয়ন কাজ শুরু হয়েছে। আর এ কাজ শেষ হলে নতুন নতুন উদ্যোক্তা সৃষ্টি ও প্রতিষ্ঠিত শিল্প কারখানাগুলো প্রাণ ফিরে পাবে বলে আশা করছেন বিসিক কর্তৃপক্ষ।

প্রতিষ্ঠার ছয় দশকেও উন্নয়নের ছোঁয়া না লাগায় ইতোমধ্যে ধীরে ধীরে বন্ধ হয়ে গেছে বিভিন্ন শিল্প-কারখানা, কমেছে কর্মসংস্থানের সুযোগ।

এদিকে উন্নয়ন কাজ শুরু হলেও বরিশাল সিটি কর্পোরেশনের সহযোগিতার অভাবে পুরো উন্নয়ন প্রকল্প বাস্তবায়ন নিয়ে শংসয় প্রকাশ করেছেন বিসিক কর্তৃপক্ষ। তবে এ বিষয়ে কোন মন্তব্য করতে রাজী হননি বরিশাল সিটি কর্পোরেশনের প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা। আর এ বিষয়ে অবগত নন বলে জানিয়েছেন বরিশাল জেলা প্রশাসক এস.এম অজিয়র রহমান।

সূত্রে জানা গেছে, বরিশালের কাউনিয়ায় ১৩০.৬১ একর জমিতে বিসিক শিল্প নগরী। সর্বমোট ১৩০.৬১ একর জমির মধ্যে ৪৪৬টি প্লটে রয়েছে ৯৭.৯৭ একর জমি। বাকি ৩২.৬৪ একর জমি অফিস সহ অন্যান্য কাজে ব্যবহৃত হচ্ছে। যাতে ৩৩৪টি উন্নত এবং ১১২টি অনুন্নত প্লট সহ মোট ৪৪৬টি প্লট রয়েছে।

ইতিমধ্যে ১৭৩টি শিল্প ইউনিটের বিপরীতে ৩৭৮টি প্লট বরাদ্দ দেয়া হয়েছে। কিন্তু নানামুখী সংকটের কারণে ১৭৩টি ইউনিটের মাত্র ৭২টি ইউনিট উৎপাদমুখী।

তদুপরী অপর্যাপ্ত বিদ্যুৎ ব্যবস্থা, বেহাল সড়ক, অবকাঠামোগত অপর্যাপ্ততা, জলাবদ্ধতা, ড্রেনেজ অব্যবস্থাপনা, গ্যাস সংযোগ ব্যবস্থা না থাকা এবং নিরাপত্তা বেষ্টনী না থাকায় উৎপাদনমুখী শিল্প কারখানার মালিকগণও রয়েছে দোটানায়।

বিনিয়োগে আগ্রহ হারিয়েছেন উদ্যোক্তারা। দিন দিন বন্ধ হয়ে যায় একাধিক শিল্প-কারখানা। ফলে কর্মসংস্থানের সুযোগ না থাকায় বেকারের সংখ্যা বাড়ছে এ অঞ্চলের মানুষের।

সব ধরনের রাজস্ব পরিশোধ করা হলেও সে অনুযায়ী কোন সেবা না পাওয়ার অভিযোগ ছিল শিল্প উদ্যোক্তাদের। এ নিয়ে স্থানীয় ও জাতীয় পর্যায়ের একাধিক সংবাদ মাধ্যমে সংবাদ প্রকাশ করা হয়।

বিসিক শিল্প নগরী সূত্রে জানা গেছে, ২০১৫ সালে বিসিক শিল্প নগরীর উন্নয়নের জন্য একটি প্রকল্প প্রস্তাবনা দেয়া হয় এবং ২০১৮ সালে বিসিক শিল্প নগরীর উন্নয়নে ৫২ কোটি ২০ লাখ টাকার এক প্রকল্প অনুমোদন হয়।

অনুমোদনকৃত অর্থের ৭০ ভাগ অনুন্নত প্লটের জন্য বরাদ্দকৃত। আর ৩০ ভাগ অবকাঠামোগত উন্নয়ন কাজের জন্য। সে মোতাবেক গত মাসের শেষের দিকে বিসিকের উন্নয়ন কাজ শুরু হয়।

যার মধ্যে রয়েছে ১০ হাজার ৫০০ ফুট সড়ক সংস্কার। যা ১৬ ফুট বিশিষ্ট পিচ ঢালাই হবে। এছাড়া সড়কের দুই পাশে আড়াই ফুট করে ৫ ফুট বিশিষ্ট ১৭ হাজার ৫০০ ফুট ড্রেন নির্মাণ এবং বিসিকের পুরো এলাকা জুড়ে নিরাপত্তা বেষ্টনী নির্মাণ কাজ শুরু হয়েছে।

যদিও প্রথম অবস্থায় ১৮০০ ফুট প্রাচীর নির্মাণের কথা ছিল। তবে অনুন্নত প্লটে বালু ভরাট করতে না পারায় বরাদ্দকৃত অর্থ ফেরত চলে যাওয়ার আশংকা করছেন বিসিক কর্তৃপক্ষ।

অনুন্নত প্লটগুলোতে বালু ফেলতে না পারার কথা জানিয়ে বরিশাল বিসিক এর উপ-মহা ব্যবস্থাক (অঃদাঃ) মোঃ জালিস মাহমুদ বলেন, সিটি কর্পোরেশনের অনুমতি না পাওয়ায় পাইপ দিয়ে বালু ফেলা সম্ভব হচ্ছে না। অথচ ট্রাক দিয়ে বালু ফেলতে গেলে বরাদ্দের চেয়ে বেশি খরচ হবে।

বরিশাল জেলা প্রশাসক এস.এম অজিয়র রহমান জানিয়েছেন, শিল্প নগরীতে উন্নয়ন কাজ টেন্ডারের মাধ্যমে ঠিকাদারী প্রতিষ্ঠানকে দেয়া হয়েছে। সেখানে তাদের যদি কোন সমস্যা থাকে সেটা তাদের ব্যাপার জানিয়ে জেলা প্রশাসক বলেন, বালু ফেলতে প্রতিবন্ধকতার বিষয়ে কেউ তাকে অবহিত করেননি।

সূত্রে জানা গেছে, বর্তমানে এখানে চালু থাকা শিল্প কলকারখানাগুলোর মধ্যে খান সন্স টেক্সটাইল মিলস, বেঙ্গল বিস্কুট লিঃ, মোহাম্মদী ইলেকট্রিক প্রজেক্ট, সুগন্ধা ফ্লাওয়ার মিলস, বরিশাল আয়রন মিলসহ অন্য শিল্প ইউনিটগুলোও চলছে খুঁড়িয়ে খুঁড়িয়ে। শুধুমাত্র ফরচুন সুজ লিমিটেড বেশ ভালভাবেই চলছে। এখানে তৈরীকৃত পণ্য পশ্চিমা বিশ্বের বিভিন্ন রাষ্ট্রসহ মোট ৩০টি রাষ্ট্রে রপ্তানী করা হয়।

অপরদিকে বরাদ্দ নিয়ে প্লটে কারখানার নাম-ঠিকানা সম্বলিত প্ল্যাকার্ড পুঁতে রাখলেও নেই কোনো কার্যক্রম। একশ্রেনীর অসাধু লোক প্লট বরাদ্দ নিয়ে সেখানে দীর্ঘদিন গোডাউন ভাড়া দিয়ে রেখেছেন।

বিসিক কর্তৃপক্ষ ওই সকল প্লটের বরাদ্দ বাতিলের জন্য সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষকে একাধিকবার জানালেও অজানা কারণে ওই সকল প্লটের বরাদ্দ বাতিল করেনি কর্তৃপক্ষ। তাদের দাবী ব্যাংক ঋণসহ নানা জটিলতা থাকায় বরাদ্দ বাতিল করা সম্ভব হচ্ছেনা।

স্থানীয় প্রবীন এক বাসিন্দা বলেন, দীর্ঘ বছর পূর্বে বিসিকে ঢুকলে মেশিনারির শব্দ পাওয়া যেত। এখন আর তা নেই। আজ কেবল সেগুলো স্মৃতি উল্লেখ করে তিনি বলেন, দেশ এগিয়েছে ঠিকই কিন্তু বিসিকে নতুন কোন শিল্প কারখানা গড়ে না ওঠায় এমনটি হয়েছে।

নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক বন্ধ হয়ে যাওয়া একটি কারখানার মালিক বলেন, দীর্ঘদিন ধরে পূর্ণাঙ্গ শিল্পনগরী গড়ে না ওঠার মূল কারণ ঋণপ্রাপ্তির ক্ষেত্রে নানা জটিলতা। ক্ষুদ্র ও কুটির শিল্পের আওতায় এখানে বিদ্যুতের তেমন কোনও সুযোগ-সুবিধাও পাওয়া যায় না।

যে ৫০টি কারখানা চালু আছে সেগুলোর প্রতিদিন ৩ মেগাওয়াট বিদ্যুৎ প্রয়োজন। অথচ পাচ্ছে মাত্র ১ মেগাওয়াট। সার্বক্ষণিক বিদ্যুৎ ও আলাদা ফিডারের আওতায় এনে কারখানাগুলোকে নিয়মিত সচল রাখা প্রয়োজন বলে মনে করেন তিনি।

তবে আশার কথা হচ্ছে, পায়রা বন্দর পুরোপুরি চালু হলে এবং পদ্মা সেতুর নির্মাণকাজ শেষ হলে বরিশালে শিল্প কারখানা প্রতিষ্ঠার আশা দেখছেন জেলার ব্যবসায়ীরা।

পায়রা বন্দর চালু হলে এই অঞ্চলের পণ্যের কাঁচামাল পরিবহন সহজ হবে। বরিশালে তৈরী পণ্য দেশ বিদেশে রপ্তানী প্রক্রিয়ায় সমস্যা দূর হবে। এতে বরিশালে বিনিয়োগ বাড়বে বলেও মনে করেন ব্যবসায়ীরা।

ষাটের দশকে নির্মিত বিসিক শিল্প নগরীতে পানি ও বিদ্যুৎ সরবরাহ ব্যবস্থা এখনও চাহিদার তুলনায় খুবই কম। এছাড়া মাওয়া ও চাঁদপুর ফেরীঘাটের সমস্যা উল্লেখ করে বরিশাল বিসিক শিল্প নগরী ব্যবসায়ী সমিতির সভাপতি ও সবচেয়ে বড় শিল্প প্রতিষ্ঠান ফরচুন সুজ লিঃ এর চেয়ারম্যান জনাব মিজানুর রহমান বলেন, মহাসড়ক এবং নদীবন্দর দূরে থাকায় এখানে উৎপাদিত শিল্পপণ্য সারাদেশে ছড়িয়ে দিতে মালিকদের বাড়তি অর্থ ব্যয় করতে হয়। তিনি আরো বলেন, নতুন উদ্যোক্তাদের ক্ষেত্রে ঋণের সহজলভ্যতা না থাকায় নতুন নতুন উদ্যোক্তা সৃষ্টি হচ্ছে না।

এছাড়া অনুন্নত প্লটগুলোতে বালু ভরাট করতে না পারায় নতুন শিল্প কারখানা স্থাপনের বিষয়ে তিনিও শংসয় প্রকাশ করেন।

বরিশাল বিসিক এর উপ-মহা ব্যবস্থাক (অঃদাঃ) মোঃ জালিস মাহমুদ বলেন, বিসিক এর উন্নয়নে ৫২ কোটি ২০ লাখ টাকার প্রকল্প বরাদ্দ হয়েছে। কিন্তু বর্তমানে শুধুমাত্র অভ্যন্তরীন সড়ক সংস্কার, ড্রেন ব্যবস্থা, সীমানা প্রাচীর নির্মাণ কাজ শুরু হয়েছে। যার প্রকল্প ব্যয় ধরা হয়েছে ১৩ কোটি টাকা।

তিনি বলেন, ইবনে সিনা ওষুধ কোম্পানী, রেফকো ল্যাবরেটরীজ, মটর সাইকেল উৎপাদনকারী প্রতিষ্ঠানসহ একাধিক প্রতিষ্ঠিত কোম্পানী প্লট বরাদ্দ চাইলেও অনুন্নত প্লটগুলো উন্নত করতে না পারায় তারা ফিরে যাচ্ছেন।

অথচ ওই প্লটগুলো উন্নত করতে পারলে এ অঞ্চলের কমপক্ষে ৩০ থেকে ৪০ হাজার লোকের কর্মসংস্থানের সুযোগ সৃষ্টি হতো জানিয়ে তিনি বলেন, বর্তমানে উন্নয়ন কাজ শেষ হলে বরিশাল বিসিক শিল্পনগরীকে খুব দ্রুতই একটি মডেল শিল্প নগরী হিসেবে উদ্যোক্তাদের উপরহার দিতে পারব। এজন্য তিনি স্থানীয় জনপ্রতিনিধি, স্থানীয় প্রশাসন, ব্যবসায়ী ও সাংবাদিকদের সহযোগিতা কামনা করেছেন।

About The Author