ইসলামে বড়দের প্রতি সম্মান ও মর্যাদা
1 min readশরীয়তে প্রত্যেক মুসলমানের জন্য করা নির্দেশ দেয়া হয়েছে যে, যদি কোনো মুসলমান ভাই তোমাদের কাছে আসে, তবে তার হক হলো সেই ব্যক্তিকে সম্মান করা। হাদিস শরিফে এতটুকু পর্যন্ত এসেছে- যদি তুমি কোনো উঁচু স্থানে বসে থাক, কোনো মুসলমান তোমাদের সাক্ষাতে আসে, তার সম্মানে সামান্য নড়ে বস। এমন যেন না হয়, কোনো মুসলমান ভাই তোমাদের সাক্ষাতে আসে, তার সম্মানে একটুও নড়ে বসো না, মূর্তির মতো বসে থাক, এটা তার সম্মানের পরিপন্থী। তাই স্বীয় স্থান থেকে সামান্য নড়ে বসা চাই, যাতে আগন্তুক মনে করে সে আমার আসায় আমাকে সম্মান করেছে।
বড়দের প্রতি সম্মান দেখানোর কিছু উপায়-
সম্মানের জন্য দাঁড়িয়ে যাওয়া
একটি পদ্ধতি হলো অন্যদের সম্মানের জন্য দাঁড়িয়ে যাওয়া। যেমন কেউ কারো কাছে আসল, তার সম্মানে স্বীয় স্থান থেকে দাঁড়িয়ে যাবে। এর শরীয়ত বিধান হলো-যদি আগমনকারী কামনা করে তার সম্মানে মানুষ দাঁড়াবে, এ দাঁড়ানো বৈধ হবে না। কারণ এ কামনা তার ভেতরে অহংকারের প্রতীক এবং সে অন্যদের ছোট মনে করে। এ জন্য সে চায় অন্যরা তার জন্য দাঁড়িয়ে যাক। শরীয়তের নির্দেশ হলো এমন ব্যক্তির জন্য দাঁড়াবে না। তবে যদি আগমনকারীর অন্তরে যদি এ কামনা না থাকে যে, মানুষ আমার জন্য দাঁড়াবে, এখন যদি তার জ্ঞান, তাকওয়া ও পদমর্যাদার কারণে তার সম্মানে দাঁড়িয়ে যায়, এতে কোনো অসুবিধা নেই। কোনো পাপও হবে না এবং দাঁড়ানো ওয়াজিবও নয়।
হাদিসে দাঁড়ানোর প্রমাণ
রাসূল (সা.) কখনো সাহাবায়ে কেরামকে দাঁড়ানোর নির্দেশ দিয়েছেন। বনু কুরাযার ব্যাপারে ফায়সালা করার জন্য যখন হযরত সাআদ ইবনে মুয়ায (রা.) কে রাসূল (সা.) ডাকলেন এবং তিনি তাশরিফ আনালেন, তখন রাসূল (সা.) বনু ক‚রায়যার লোকদের বললেন ‘তোমাদের সর্দারের আগমনে তোমরা দাঁড়িয়ে যাও’। অতএব এরূপ ক্ষেত্রে দাঁড়ানো জায়েজ আছে। যদি না দাঁড়ায় এতেও কোনো অসুবিধা নেই। তবে হাদিসে এ কথার তাগিদ এসেছে- কারো আগমনে এমন যেন না হয়-মূর্তির মতো বসে থাকবে। কোনো নড়াচড়া করবে না, আনন্দ প্রকাশও করবে না। বরং তিনি বলেন, কমপক্ষে এতটুকু কর, স্বীয় স্থান থেকে একটু নড়ে চড়ে বস, যাতে আগমনকারী মনে করে-আমাকে সম্মান করেছে।
মুসলমানের সম্মান ঈমানের সম্মান
এক মুসলমানের সম্মান তো মূলত তার অন্তরে প্রোথিত ঈমানের সম্মান। কোনো মুসলমান যখন কালিমায়ে তায়্যিবা এর উপর ঈমান রাখে এবং ওই ঈমান তার অন্তরে থাকে, তার দাবি ও হক হলো তাকে সম্মান করা। যদিও তার বাহ্যিক অবস্থা দুর্বল দৃষ্টিগোচর হয় এবং তার আমল ও পোশাক-আশাক পূর্ণ দ্বীন মোতাবেক না হয়। তোমার তো জানা নেই-তার অন্তরে আল্লাহ তায়ালা যে ঈমান দিয়েছেন তা কোন স্তরের। আল্লাহ তায়ালার এখানে তার ঈমান গ্রহণযোগ্য। শুধু বাহ্যিক রূপ-অবয়ব দ্বারা তা অনুমান করা যায় না। এ জন্য প্রত্যেক আগমনকারী মুসলমানকে মুসলমান হিসেবে সম্মান করা চাই।
সম্মানিত কাফেরের মর্যাদা দান
প্রতিটি মুসলমানকে সম্মান করার নির্দেশ দেয়া হয়েছে। হাদিসে এটাও এসেছে-আগন্তুক কাফের হলেও। যদি তাকে সম্প্রদায়ের মধ্যে মনে করা হয়, তাকে সম্মান করা হয়, মানুষ তাকে সম্মানের দৃষ্টিতে দেখে, তাকে বড় হিসেবে মানতে চায় সে কাফের অমুসলিম হোক না কেন। তার আগমনে তোমরাও সম্মান করো। তাকে সম্মান করা ইসলামি চরিত্রের দাবি। এ সম্মান তার কুফুরের নয়। কারণ তার কুফুরের প্রতি তো ঘৃণা থাকবে, তবে যেহেতু তাকে তার সম্প্রদায়ের মাঝে সম্মানিত মনে করা হয় এই জন্য যখন সে তোমাদের কাছে আসবে তোমরা তার আতিথেয়তার জন্য তাকে সম্মান করো। এমন যেন না হয়-তাকে ঘৃণা করার ফলে সে তোমাদের ও তোমাদের দ্বীনের প্রতি ঘৃণাকারী হয়ে যায়, এই জন্য তাকে সম্মান করো।
কাফেরদের সঙ্গে রাসূল (সা.) এর কর্মপদ্ধতি
রাসূল (সা.) এরূপ করে দেখিয়েছেন। যখন তার কাছে কাফেরদের বড় বড় সরদাররা আসত, কখনো তারা অসম্মানজনক আচরণ অনুভব করত না। বরং তিনি তাদের ইজ্জত ও সম্মান করতেন। তাদেরকে সম্মানের সঙ্গে বসাতেন। স্বসম্মানে তাদের সঙ্গে কথা বলতেন। এটি নবী করীম (সা.)-এর সুন্নত। যদি কাফেরও আমাদের কাছে আসে তাকেও সম্মান করতে হবে।
এক কাফের ব্যক্তি ঘটনা
হাদিস শরিফে এসেছে, একবার নবী করীম (সা.) ঘরে তাশরিফ নিলেন। এক ব্যক্তিকে আসতে দেখা গেল। হযরত আয়েশা রা. নিকটেই ছিলেন। রাসূল (সা.) বললেন, হে আয়েশা! আগন্তুক লোকটি তার গোত্রের একজন মন্দ লোক। এরপর যখন লোকটি রাসূল (সা.) এর খেদমতে আসল তিনি দাঁড়িয়ে তাকে সম্মান করলেন। সম্মানের সঙ্গে তার সঙ্গে কথাবার্তা বললেন। কথাবার্তা বলার পর যখন সে চলে গেল, হযরত আয়েশা রা. বললেন, ইয়া রাসূলাল্লাহ! আপনি নিজেই বলেছেন এ লোকটি তার গোত্রের মন্দ লোক। কিন্তু যখন সে আসল আপনি তাকে বড় সম্মান করেছেন। নম্রতার সঙ্গে তার সঙ্গে কথা বলেছেন। এর কারণ কী? রাসূল (সা.) বললেন, সে বড়ই মন্দ লোক। তার অনিষ্টতা থেকে রক্ষা পেতেই তাকে সম্মান করা।
এ পরনিন্দা বৈধ
এ হাদিসে দু’টি প্রশ্ন হয়। ১ম প্রশ্ন হলো যখন ওই ব্যক্তি দূর থেকে আসছিল, তার আগমনের পূর্বে তার অগোচরে রাসুল (সা.) হযরত আয়েশা রা. এর কাছে তার মন্দ বর্ণনা করেছেন-লোকটি তার সম্প্রদায়ের মন্দ লোক। বাহ্যত প্রতীয়মান হয়-এটা গীবত। কারণ কারো অগোচরে তার মন্দ বর্ণনা করা হচ্ছে। উত্তর হলো-বাস্তবে এটি গীবত নয়। কারণ যদি কাউকে অন্য কোন ব্যক্তির অনিষ্টতা থেকে বাচানোর নিয়তে তার দোষ বর্ণনা করা হয় এটি গীবত নয়। যেমন কোনো ব্যক্তি অন্য কাউকে সতর্ক করার জন্য বলল, তুমি অমুক ব্যক্তি থেকে একটু সতর্ক থেকো, যেন সে তোমাকে ধোঁকা দিতে বা কষ্ট দিতে না পারে। তাহলে এটা গীবতের অন্তর্ভুক্ত হবে না। হারাম ও না জায়েজ হবে না।
বরং কোন কোন সূরতে তো বলে দেয়াটা ওয়াজিব হয়ে যায়, যেমন আপনার নিশ্চিত জানা আছে অমুক ব্যক্তি অমুক ব্যক্তিকে ধোকা দেবে। ফলে প্রতারিত ব্যক্তির জান-মাল ক্ষতির আশংকা হয়, তাহলে আপনার উপর ওয়াজিব দ্বিতীয় ব্যক্তিকে বলে দেয়া যে, অমুক ব্যক্তি তোমাকে ধোকা দিতে চায় যাতে সে তার থেকে বেঁচে থাকতে পারে। এটা গীবতের অন্তর্ভুক্ত নয়। অতএব রাসূল (সা.) যখন আয়েশা রা. কে বলে দিয়েছেন-এ লোকটি গোত্রের মন্দ লোক। এ বলে দেয়ার উদ্দেশ্য হলো যাতে সে হযরত আয়েশা (রা.) কে কখনও ধোঁকা দিতে না পারে। অথবা তার উপর ভরসা করে হযরত আয়েশা (রা.) নিজে বা অন্য কোনো মুসলমান এমন কাজ করে বসে যার কারণে পরে আফসোস করতে হয়। এই জন্য রাসুল (সা.) হযরত আয়েশা (রা.) কে তার ব্যাপারে প্রথমে বলে দিয়েছেন।
মন্দ লোককে তিনি সম্মান করলেন কেন?
দ্বিতীয় প্রশ্ন হলো, একদিকে তিনি তাকে মন্দ লোক বলেছেন অন্যদিকে তাকে যথাযথ সম্মান করেছেন, নম্র আচরণ করেছেন। এতে বাহ্যিক ও আভ্যন্তরীণ, সামনে ও পেছনের মধ্যে কিছু পার্থক্য হয়ে যায়। আসল কথা হলো ইনি আল্লাহর রাসূল (সা.)। যিনি প্রতিটি জিনিসের সীমা বর্ণনা করেছেন। তাই সতর্ক করার জন্য তো বলে দিয়েছেন-এ লোকটি মন্দ লোক। তবে যখন সে আমার অতিথি হয়ে আসলো, অতিথি হিসেবে তার কিছু অধিকার আছে। তা হলো-অন্যান্য অতিথিদের মতো তাকে সম্মান করবো। রাসূল (সা.) এমনটাই করেছেন।
সে লোকটি অনেক মন্দ
এ হাদিসে সঙ্গে সঙ্গে এটিও বলে দিয়েছেন যে, এ সম্মান করার একটি হেকমত হলো, যদি মন্দ লোকের সম্মান না করা হয়, হতে পারে সে তোমাদেরকে কোনো কষ্ট দেবে বা বিপদে ফেলবে অথবা তোমাদের সঙ্গে এমন কোনো লেনদেন করবে যার ফলে তোমাদেরকে ভবিষ্যতে আফসোস করতে হবে। এই জন্য যদি কোনো মন্দ লোকের সাক্ষাতের সুযোগ এসে যায় তাকে সম্মান করাতে কোনো অসুবিধা নেই।
তার অনিষ্টতা থেকে নিজের জান-মাল-সম্মান রক্ষা করাও মানুষের অবশ্য করণীয় বিষয়ের অন্তর্ভুক্ত। এই জন্য রাসূল (সা.) এ হাদিসে পরিষ্কারভাবে বলে দিয়েছেন, সে লোকটি অনেক মন্দ, যার অনিষ্টতা থেকে বাঁচতে মানুষ তার সম্মান করে। মানুষ তার সম্মান এই জন্য করে না যে সে ভালো মানুষ, বরং তাকে সম্মান করার কারণ হলো, সম্মান না করলে সে কষ্ট দেবে। এমতাবস্থায় সম্মান করাতে কোন অসুবিধা নেই। শর্ত হলো সম্মান করতে হবে বৈধ সীমার ভেতরে থেকে, এ কারণে কোন পাপে জড়ানো যাবে না।
রাসূল (সা.) এর পবিত্র আদর্শের একেকটি অংশে আমার আপনাদের জন্য অসংখ্য শিক্ষা মওজুদ রয়েছে। তিনি গীবতের সীমা বলে দিয়েছেন, এতটুকু কথা হলে গীবত হবে আবার এতটুকু গীবত নয়। আর সম্মান করাতে কোনো কপটতা হবে না। বরং আগমনকারী চাই সে কাফের, ফাসেক ও ফাজির হোক না কেন যখন সে তোমার কাছে অতিথি হিসেবে আসে তুমি তাকে সম্মান করো, তাকে ইজ্জত করো, এটা কপটতার অন্তর্ভুক্ত হবে না।